-অর্ক, আমি অন্য অনেকের চেয়ে ভালো আছি। দিল্লি পুলিশ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার মোবাইল ফোনটা সিম-সমেত শেষমেষ ফেরত পেয়েছি। যদিও আমি কাদের সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলি এ বিষয়ে সমস্ত তথ্যই ওদের কাছে আছে। তোমার আমার কথাবার্তার বিষয়েও নিশ্চিত ওরা জানে। তবে আমার জীবিকার জন্যে আমার মোবাইলটা জরুরি, সেটা ফেরত পেয়েছি। ৪৫ জনের বেশি সাংবাদিক, লেখক, অধ্যাপক, গ্রাফিক ডিজাইনার, যারা কোনো না কোনোভাবে নিউজক্লিক-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁরা নিজেদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলি ফেরত পাননি। অনেকের পাসপোর্ট ও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমি বলেছিলাম, আমার মোবাইল ল্যাপটপ এসব জমা করতে গেলে আমায় লিখিত দিতে হবে। তখন আমায় ওরা ওদের দফতরে ডাকে। সেখানে একটা সিজার মেমো দেয়।
প্রায় ১০ ঘণ্টা ছিলেন আপনি সেখানে। কেমন ব্যবহার পেলেন?
খুবই বিনীত আচরণ। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল, চা খাব না কফি খাব? পুরির সঙ্গে আলু খাবো না ছোলা খাবো? আমি আশা করি, আমার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে সেই একই ব্যবহার করা হবে অমিত চক্রবর্তী ( নিউজক্লিক-এর এইচআর হেড) এবং প্রবীরের সঙ্গে। তুমি তো জানো অমিত বিশেষভাবে সক্ষম।
আপনি না হয় সিজার মেমো নিয়ে মোবাইলটা দিলেন, সবাই এই সিজার মেমো পেয়েছে?
এই কাজটা আইনি না বেআইনি- এ নিয়ে নানা লোকের নানামত। মনে রেখো, মোবাইল বা ল্যাপটপ দিলে হবে না, পাসওয়ার্ডটাও তোমায় টাইপ করে দিতে হবে। একটা মত হলো, পাসওয়ার্ড যদি না দাও, মোবাইল দিতে যদি অস্বীকার করো, ওরা বলবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টা আরো ঘোরালো হয়ে উঠবে। ফলে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা বাধ্য হয়েই মোবাইল ল্যাপটপ জমা করে দিচ্ছে।
আপনাদের সবাইকে নাকি ঘুরিয়েফিরিয়ে একই প্রশ্ন করা হচ্ছিল? আপনাকে কোনো বিশেষ প্রশ্ন করা হয়?
হ্যাঁ, মোটামুটি সবাইকেই একই প্রশ্ন করা হচ্ছিল। একই প্রশ্ন বারবার করা হচ্ছিল। কোথায় পড়াশোনা করেছি, আমার ব্যাংক একাউন্ট নম্বরটা কী-এসব। এছাড়াও আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় আমি নেভিল রয় সিংঘমকে চিনি কিনা, আমি গৌতম নভলাখাকে চিনি কিনা, আমি দিল্লির দাঙ্গা কভার করেছিলাম কিনা, কৃষক আন্দোলন কভার করেছি কিনা। আসে কল লিস্ট প্রসঙ্গ। আমি অস্ট্রেলিয়ার এক ব্যক্তিকে কল করেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে আমি জবাব দিই, হ্যাঁ, করেছি তিনি আদানিওয়াচ-এর সঙ্গে যুক্ত, আমি সেই সংস্থার জন্য লেখালেখি করি। জিজ্ঞেস করা হয়, হংকংয়ে এক ব্যক্তিকে আমি কল করেছি কিনা। জিজ্ঞেস করা হয়, আমেরিকায় এস ভাটনগর থাকেন। তাঁকে আমি কেন কল করেছি? আমি জানাই, উনি আমার শ্যালক।
নিউজক্লিক প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করেনি ওরা?
হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করা হয়, আমি নিউজক্লিক থেকে কত টাকা পাই। আমি জানাই, আমি ইনভয়েস দিয়ে টাকা নিই। আমি আয়কর দিই। এর আগে ইডিও তথ্য নিয়েছে। ফলে কোথাও কোনো অস্বচ্ছতা নেই আমার তরফে।
আপনার কি মনে হয়, প্রবীর পুরকায়স্থ-কে ভোটের আগে টার্গেট করা হলো?
তুমি গোটা তৎপরতাটা ধাপে ধাপে খেয়াল করো। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম ইডি গিয়েছিল নিউজ ক্লিক-এ। প্রবীর গীতাকে ৫ দিন সে সময় বাড়ি থেকে বেরোতে দেওয়া হয়নি। তারপর যায় আয়কর বিভাগ। তারপর ইকনোমিক অফেন্স উইং। তিনবছরে ওদের বিরুদ্ধে একটা চার্জশিট তৈরি করা যায়নি। এরপর বিচার চেয়ে আদালতে গিয়েছিল প্রবীররা। সেই ট্রায়াল শুরু হওয়ার আগেই ইউএপিএ-এর মতো আইনের আওতায় আনা হলো প্রবীরকে৷
দিল্লি পুলিশের প্রস্তুতিটা সেদিন কেমন ছিল?
সব মিলে দু’শো পুলিশ ছিল। তারা কেউ সারারাত ঘুমোননি৷ চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ ছিল ওদের। আদেশ ছিল কাকভোরেই ৪০ টা জায়গায় যেতে হবে। কথা বলতে হবে সবার সঙ্গে। একজন মহিলা চারটে লেখা লিখেছেন নিউজক্লিকে, তাঁর বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছে ওরা। কেউ কপি সম্পাদনা করে, কেউ অতি সাধারণ গ্রাফিক ডিজাইনার, তাঁরাও ছাড় পাননি।
দিল্লি পুলিশের এফআইআর নিয়ে আপনার কী মতামত? জরুরি অবস্থা ফিরে এল?
এফআইআর-এ বলা হয়েছে তোমরা বিদেশ থেকে পয়সা পেয়েছ। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি দালাল তোমরা। মহামারীর সময়ে সরকারের কাজের নিন্দা করেছ। দিল্লির দাঙ্গায় ইন্ধন দিয়েছ। দেশের অখণ্ডতা নষ্ট করেছ। তোমরা নকশালদের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সবটাই দেখেছি। আমি এটুকুই বলব, জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা অনেক সাংবাদিককে জেলে ভরেছিলেন। সেই ঘটনার পর অনেক বছর কেটে গিয়েছে। আমি ৪৫ বছর সাংবাদিকতা করছি। এমন ব্যবস্থা আগে দেখিনি। দিল্লি পুলিশ যে এই ধরনের অ্যাকশন নেবে অনেকেরই ধারণাতেও ছিল না। সুপরিকল্পিত ভাবে, একদিনে বেছে বেছে এত সাংবাদিকদের বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হয়নি জরুরি অবস্থার সময়েও।
ইউএপিএ-এর মতো সাংঘাতিক আইন ব্যবহার আসলে কি অভিযুক্তকে লম্বা সময় বিচারহীন করে রেখে দৃষ্টান্ত তৈরি করা নয়?
ইউএপিএ একটা ড্রাকোনিয়ান অ্যাক্ট। অতি কঠোর দমনমূলক আইন। এটার একটা প্রভাব তৈরি হয় তাড়াতাড়ি। ৪০ জন সাংবাদিকের বাড়িতে গিয়েছে ওরা। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে আরও ৪০০ সাংবাদিককে বলা হচ্ছে, দেখো আমরা কী করতে পারি৷ তোমার রোজগারের সমূহ ক্ষতি হতে পারে। তোমার কেরিয়ার ধ্বংস হতে পারে। ইংরেজিতে একে বলে চিলিং এফেক্ট।
প্রবীর পুরকায়স্থদের অপরাধী প্রমাণ করতে নিউইয়র্ক টাইমস- এর একটা প্রতিবেদনই যথেষ্ট মনে করছে দিল্লি পুলিশ?
দু’মাস আগে নিউইয়র্ক টাইমস একটা লেখা ছাপল সিংঘম-এর সঙ্গে নিউজক্লিক-এর আর্থিক সম্পর্ক আছে এই মর্মে। সিংঘম অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি। বলা হয়েছে, নানা দেশে বাম মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন সংস্থাকে তিনি অর্থ সাহায্য করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস কিন্তু বলেনি, তিনি কোনো অন্যায় করেছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিতও পাইনি। ফলে আমি যুক্তিটাই বুঝতে পারছি না। আমরা সবাই রাষ্ট্রদ্রোহী? প্রশ্ন করলেই রাষ্ট্রদ্রোহ? আমার মনে হয় না আদালত এটা মানবে। তবে এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকে আদালতের দিকেই তাকিয়ে থাকতে চাই।
গোদি মিডিয়ার চেনামুখগুলি কী বলছে?
গোদি মিডিয়ার ঘনিষ্ঠ লোকজনেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমায় বলছে, আমি চিনের দালাল। আকছার আমার মোবাইলে ই-মেল-এ অশ্লীল মেসেজ আসতে থাকে।
আজ শেষ করি। একটা প্রশ্ন, আপনি তো আদানির বিষয়ে চুপ করে গিয়েছিলেন আদালতের নির্দেশে। আড়াই বছর পর মুখ খুললেন কেন?
আমি বুঝতে পেরেছিলাম মুখ বন্ধ রেখে কোনো লাভ হবে না। ছ’টা মানহানির মামলা রয়েছে। আরও ছ’টা মামলা হবে। ওদের হাতে অনেক ক্ষমতা। অনেক টাকা। আমি দেশের একমাত্র নাগরিক যাঁর বিরুদ্ধে আদানি গোষ্ঠী ছ’টি মানহানির মামলা করে রেখেছে। হিন্ডেনবার্গ আদানি গোষ্ঠীকে জিজ্ঞেস করে, কেন পরঞ্জয়ের বিরুদ্ধে এই কঠোর পন্থা নিতে হল? তারপর আমি তোমার সঙ্গেই প্রথম কলকাতা প্রেস ক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে লম্বা কথাবার্তা বলি। আমি ঠিক করেছি আমি আর চুপ করে থাকব না।