কলকাতার মাল্টিপ্লেক্সগুলিতে গুটিকয়েক লোক দেখছে নন্দিত দাসের সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা জুইগাটো। বিষয় ডেলিভারি শ্রমিকের রোজের জীবন। যে জীবন দাসের সে জীবন ত্রাসেরও, লোকে দেখেও দেখে না। এই জীবনদর্শন নিয়েই নন্দিতা দাসের সঙ্গে কথাবার্তায় অর্ক দেব।
আপনাকে অভিনন্দন জানাই জুইগাটো ছবিটির জন্য৷ গিগ অর্থনীতি নিয়ে ছবি করার ভাবনা মাথায় এল কী ভাবে?
আমার প্রকাশক বন্ধু সমীর পাতিলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব আর এই গিগ কাজগুলির জটিলতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখান থেকেই এই ছবিটির ভাবনা শুরু হয়। আমরা একজন ডেলিভারি শ্রমিকের একদিনের জীবন নিয়ে একটি শর্ট ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি। তারপর সমীর (নায়ার), অ্যাপলউজ এন্টারটেইনমেন্টের সিইও, যিনি এই ছবিটির প্রোডিউসার, জোরাজুরি করতে শুরু করেন, যেন এটাকে আমি শর্ট ফিল্ম না করে ফিচার ফিল্মে আকার দেওয়ার কথা ভাবি। নতুন টেকনোলজির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই, শ্রমিকদের মূল্যহীন যন্ত্রের মতো জীবন, এই মানাবিক ভাবনাগুলি আমায় একরকম পেড়ে ফেলেছিল। চার্লি চ্যাপলিন মডার্ন টাইমস ছবিতে মানুষ আর মেশিনের সংঘাত দেখিয়েছিলেন, আজকে এই গিগ অর্থনীতির রমরমায় ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ বনাম অ্যালগোরিদম। জুইগাটো ছবিটা আসলে জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার, যে জীবনে একই সঙ্গে রূপোলি আলোর রেখাও আছে।
গিগ ইকনোমি প্রতিদিন কী ভাবে একজন শ্রমিকের শরীর মনকে ক্রমে কী ভাবে বিমানবিকীকরণ করে, আপনার ছবিতে ধরা পড়েছে৷ ছবির প্রস্তুতির দিনগুলি, মানে এই বাস্তবচিত্রটার মুখোমুখি হওয়ার দিনগুলির কথা যদি বলেন?
মহামারীর দিনগুলিতে আমরা ক্রেতারা আমাদের স্বার্থে গিগ শ্রমিকদের উপর নির্ভরতা অনেকটা বাড়িয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু তাদের প্রতিদিনের লড়াই সম্পর্কে আমাদের ন্যূনতম সচেতনতা ছিল না। আমরা সব্বাই স্রেফ অর্ডার করেছি। ধন্যবাদ বলিনি, রেটিং দিইনি, ওদের অস্তিত্বটাই স্বীকার করিনি। এটা জায়গাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল। এর পাশাপাশি জুইগাটো শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গের ব্যাপারে আমাদের যে স্বাভাবিত পক্ষপাত তাকেও তুলে ধরে। ছবিতে এই বিষয়গুলি সূক্ষ্মভাবে নিজের মতো করে জায়গা করে নিয়েছে, অদেখাকে দৃশ্যমান করেছে। কোভিড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ওঁরা যাঁরা আমাদের চেয়ে অনেকটা ক্ষয়াটে, জীবন তাঁদের জন্য আরো অনেক গুণ বেশি নির্দয়।
ছবিটা শুরু করার আগে আমি এই ইনসেনটিভ আর অ্যালগোরিদমের বিষয়ে ঠিক ততটাই অবগত ছিলাম যতটা আমার প্রধান চরিত্র
(কপিল শর্মা অভিনীত চরিত্র, ছবিতে যাঁর নাম মানস) এসব বোঝে, ততটাই বুঝতাম। কিন্তু যত সময় গিয়েছে, গিগ অর্থনীতি সম্পর্কে যত বুঝতে পেরেছি আমি, তত অবাক হয়েছি, তত বিধ্বস্ত লেগেছে। বহু শ্রমিকের সঙ্গে আমরা ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলেছি। ওঁদের অভিজ্ঞতা শুনেছি। লড়াই, ভয়, দ্বিধা আর আশার গল্পগুলি থেকেই এই পৃথিবীটাকে আমি নিবিড়ভাবে বুঝতে পেরেছি। পাশাপাশি আমরা এই ফু়ড ডেলিভারি সংস্থাগুলির প্রাক্তন কর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেছি। গোপনীয়তা রক্ষার চুক্তি মেনে কথা বলেছি ডেলিভারি অ্যাপগুলির পরিসংখ্যান বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজারদের সঙ্গেও।
যত দূরের অর্ডার আসে ডেলিভারি শ্রমিকরা ততই জ্বালানি বাবদ খরচ করতে বাধ্য হন। নিজেদের জোনে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য পেট্রোল খরচ পান ওঁরা, কিন্তু ফেরার খরচটা বহন করতে হয় নিজেকেই। এটা কিন্তু শুধু ভারতের ব্যাপার নয়, বিশ্বের সর্বত্রই ব্যবস্থাটা এরকম। এই ‘জোন’, মানে অর্ডার যে ভৌগোলিক চৌহদ্দি থেকে আসছে, তার আয়তন সামান্য বাড়া কমাটা রীতিমতো ওঁদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক, এটা জেনে চমকে গেছিলাম। আমার পর্যবেক্ষণ এই, সমস্ত লড়াই, সামান্য অর্থের জন্য রোজের লম্বা শিফট, পেট্রলের মূল্যবৃদ্ধি,রেটিং আর ইনসেনটিভের অনিশ্চয়তার মধ্যেই ওঁরা কিন্তু আশাটাকে বাঁচিয়ে রাখেন।
কেন লোচ গিগ শ্রমিক যন্ত্রণা নিয়েই বানিয়েছেন, ‘সরি উই মিসড ইউ’। এই ছবিটি কি আপনি দেখেছিলেন? কোনো ভাবে কি কেন আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
জুইগাটো আর কেন লোচের সরি উই মিসড ইউ-র প্রতিতুলনা হচ্ছে। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ আহ্লাদের। তবে ভাগ্যিস আমি ছবিটা দেখেছিলাম আমার ছবির কাজ শেষ করে। কেন লোচের ছবিটা ব্রিটেনে সামাজিক আবহে তৈরি, ছবিটার মূল সুর হতাশা। কিন্তু আমাদের এখানে দেখবেন সব যখন হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে তখনও মানুষ আশায় বাঁচে। জুইগাটোর ট্রিটমেন্টটের ধরনও এটাই।
আপনার ছবিটি কলকাতায় মাল্টিপ্লেক্সগুলিতে দেখানো হচ্ছে। দেখছে গুটিকয়েক সচেতন লোক। আপনি তো জানেন আমাদের ছোট শহর মফসসলগুলিতে সিঙ্গল স্ক্রিনগুলি রোজই বন্ধ হচ্ছে। গিগ শ্রমিক হোন বা অন্য সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখতে যাওয়া তো তাদের জন্য বিলাসিতা। এই জায়গাটা নিয়ে আপনি ভেবেছেন? ডেলিভারি শ্রমিকদের ছবিটা দেখানোর, রাস্তার ধারে স্ক্রিনিং করার কোনো পরিকল্পনা আছে আপনার?
আমরা রাইডারদের জন্য কয়েকটা স্পেশ্যাল স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু আমার কাছে, এই ছবিটা অনেক বেশি আমাদের মতো মানুষের জন্য যারা সমষ্টিগত চেতনার জায়গা থেকে, নিজেদের গল্প থেকে ওঁদের উপড়ে ফেলি। ওঁরা কিন্তু ওদের লড়াইটা জানে। বরং আমরা যারা ওদের জন্যেই প্রতিদিন আরও একটু সুবিধেয়, আরামে বাঁচি, তারাই অসংবেদনশীল আচরণ করি। ফলে আমাদের মতো মানুষেরা ছবি দেখতে গেলে, ছবিটা আমাদের শ্রেণিকে ভাবালে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো।
গিগ অর্থনীতিতে শ্রেণি, ধর্ম ডেলিভারির ক্ষেত্রে শর্ত হয়েছে বহু জায়গায়৷ এই জায়গাটা আপনার ছবিতে খুব বড় করে ধরা পড়েনি। এই ব্যপারটা কি আপনাকে তেমন ভাবায়নি?
আপনার প্রশ্নটায় আমি একটু চমকে গেলাম। কারণ অনেকেই কিন্তু বলেছেন শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ-সব ধরনের বৈষম্যের দিকগুলি চাপিয়ে না দিলেও আমি ছুঁয়ে গিয়েছি। আমি জানি না হর্ষ মান্দারের আলোচনাটা আপনার চোখে পড়েছে কিনা। এই দিকটা নিয়ে উনি বিস্তারিত কথা বলেছেন। আমি আসলে চেয়েছিলাম একটা ডেলিভারি শ্রমিকের চারদিনের জীবন লেন্সে ধরার মধ্যে দিয়ে সমস্যাগুলি কতটা তুলে ধরা যায় তা দেখতে। আমি চেয়েছি গবেষণা থেকে উঠে আসা সব তথ্যই রাখতে। কিন্তু গল্পটা স্বাভাবিক ছন্দে বলতে হবে তো। তা না করে যদি কোনো ভাবনা জোর করে চাপিয়ে দিই তবে ছবিটার উদ্দেশ্যই মাঠে মারা যাবে।
আমাদের দেশের কোনো সাংসদীয় দলই গিগ শ্রমিকদের প্রতিদিনের যন্ত্রণাকে ভোটের ইস্যু করে না। কোনো সুরাহার কথা ভাবতে পারে না। সুরাহা কি আদৌ আছে? গিগ শ্রমিকরা কী ভাবে ন্যূনতম অধিকার পেতে পারে বলে মনে হয় আপনার?
বিষয়গুলি আরও অনেক জটিল। শুধু রাজনৈতিক নেতাই নয়, এর সঙ্গে জুড়তে হবে কর্পোরেশন, মিডিয়ার মতো শক্তিস্তম্ভগুলিকে। সর্বত্র এখন এত বেশি বিকল্প, মানুষ একটা সাধারণ কারণে একজোট হয়ে কোনো অব্যবস্থার বদল ঘটাবে এমনটা ভাবা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদের ঢেউ একেবারেই নেই তা নয়। এমনকী গিগ অর্থনীতির অন্দরেও, যেখানে শ্রমিকদের কোনো অধিকার নেই, সেখানেও কথা চলছে। আমি আশাবাদী। আমি বের্টল্ট ব্রেখটের সেই কথাটা বিশ্বাস রাখি,” আঁধারে কি গান হবে? হ্যাঁ,ওঁরা আধারেরই গান গাবে।”
গিগ অর্থনীতি মহিলারা জায়গাই পান না। জায়গা পেলেও কঠিন লড়াইয়ে থই পাওয়া মুশকিল হয়। নন্দিতা দাস তো চিরকালই মেয়েদের নিজেদের জগত নিয়ে সহানুভূতিশীল, এই জায়গাটা আপনাকে ভাবিয়েছে?
দেখুন অন্য অনেক পেশার মতোই গিগ অর্থনীতিও বিপুল ভাবে পুরুষনির্ভর। কয়েকটা শহরে এখন অবশ্য মহিলারও অংশ নিচ্ছেন গিগ অর্থনীতিতে। সমাজ যত বেশি বৈষম্যমুক্ত হবে, মেয়েদের জন্য সুযোগ বাড়াবে, সব ধরনের কাজের জায়গাতেও তত এর প্রতিফলন দেখা যাবে। অনেক পথ হাঁটা বাকি, তবে হ্যাঁ, এটুকু বলতে পারি, আমরা আমাদের পথেই আছি।
আপনার ছবিতে গ্রাম থেকে শহরে আসা, শহরে প্রতারিত হয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার অভীপ্সা, এই চিরকালীন দোটানাটা অসম্ভব ভালো করে ধরা আছে। ভারতীয় ক্ষেতমজুরের আরেকটু বেশি রোজগারের স্বপ্নে শহরে আসা তারপর কাজের জন্য লড়াই, বহুতলের নির্মাণকর্মী হয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাঁচা অথবা ডেলিভারি বয়ের কাজ নেওয়া, আপনি লেন্সে ধরেছেন সব দোটনাগুলি। আপনি কি মনে করেন গ্রামে ফিরে যাওয়াটা একটা সমাধান?
সিনেমাকরিয়ে হিসেবে আমি তো কোনো সমাধান সূত্র দিতে পারি না। তবে একটা সিনেমা বহু কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, সহমর্মিতার বোধ জাগিয়ে দিতে পারে মানুষের মনে। আমার কাছে সিনেমা আমাদের ভয়, দ্বিধা আর উচ্চাশার আয়না। হ্যাঁ, এখানে হাতেগরম কোনো সমাধানসূত্র নেই, সাদা কালো নেই। প্রত্যেকের সমস্যা নিজের, সমাধানও নিজের, ওই ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন কোনটা করলে ভালো। মানস যেমন ভেবেছিল গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওঁর স্ত্রী অনেক বেশি বাস্তববাদী, উনি প্রশ্ন করেন, আদৌ এটা সমাধান কিনা। বহু সময়েই মানুষ এমন অকুল পাথারে পরে যখন দু’দিকই বন্ধ হয়ে যায়।
উন্নতিকামী রাষ্ট্র স্বাস্থ্য-শিক্ষার বাজেট কমাচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজিই ঠিক করে দিচ্ছে কে কেমন জীবন বাঁচবে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার অবস্থা তো সবার থাকে না। নাসিকের একজন কৃষককে যদি গ্রামে ফিরতে হয় তিনি তো মারা যাবেন। তবে তিনি কোথায় যাবেন? কোনো বিকল্প আছে কী?
যে সমস্যাগুলি এত জটিল, এত গভীর, তার সমাধান বাতলে দেওয়ার আমি কেউ নই। অগণিত নামহীন, মুখহীন মানুষ প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াই লড়ছেন। আমরা জিডিপি-র হিসেবে বৃদ্ধির কথা বলছি, কিন্তু বাস্তবে দরিদ্র হতভাগ্যই রয়ে গেল।
আমাদের দেখা উচিত এই অযত্নের,নির্মমতার মধ্যে আমরা প্রত্যেকে কতটা জড়িয়ে আছি। আমরা একটু বদলালেই দুনিয়ায়টাকে বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব, বৈষম্য সরিয়ে সহমর্মী হয়ে ওঠা সম্ভব। সিনেমাকরিয়ে হিসেবে এই কাজটাই আমি যতটা পেরেছি, চেষ্টা করেছি।
বহু ওলা উবের ড্রাইভারের কাছে শুনেছি ওঁরাও প্রতিদিন নানা ভাবে প্রতারিত হন। লড়াই করার পথ থাকে না। রেগে যান। রাগ নিয়েই বাঁচেন। নন্দিতা কি ওঁদের সমস্যাগুলি নিয়েও ভাবেন?
ওলা উবের ড্রাইভাররাও তো ভীষণভাবে গিগ অর্থনীতিরই অংশ । যে কেউ সংস্থা যাকে ‘পার্টনার’ বলে কর্মী বলে না, চুক্তিতে কাজ করায় , সেই গিগ অর্থনীতির অন্তর্গত। এইখানে কেউ জালে জড়িয়ে হতাশায় গুমরে মরে, কেউ আবার সুদিনের জন্য অপেক্ষা করে। অনেকে কিন্তু আবার এই কাজটাকে স্টপগ্যাপ হিসেবেও নেয়, ভালো কাজ পাওয়ার আগে যেন একটু নিশ্চয়তা থাকে, বিষাদ যেন ঘিরে না ধরে। কিছুই তো পুরোটা ভালো, পুরোটা খারাপ নয়। আঙুল না তুলে বরং এই জীবনের দিকে একটু তাকাই যা আমাদের রোজের জীবন থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে।