Interview

শারজিলকে নিয়ে সবাই চুপ কেন? কথাবার্তায় মুজাম্মিল ইমাম

শারজিলকে নিয়ে সবাই চুপ কেন? কথাবার্তায় মুজাম্মিল ইমাম

সাড়ে চার বছর পার হয়ে গেল। শারজিলের সাজাও হলো না। ওঁকে নির্দোষও প্রমাণ করা গেল না। ওঁর বিরুদ্ধে চলা মামলাগুলি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?

আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে  শারজিল যে বক্তৃতা দিয়েছিল

তার ভিত্তিতে প্রথমে শারজিলের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দেওয়া হয়। তারপর আরও তিনটে। অসম, অরুণাচল, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, মণিপুর- এই পাঁচ জায়গা থেকে ওঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।  প্রথম মামলা হয় ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি। ২৮ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করেন শারজিল। এর পরে জামিয়া মিলিয়ার এফআইআর-এ মার্চ ও এপ্রিলে শারজিলের নাম জড়ানো হয়।  এর দুমাস বাদে শারজিলকে দিল্লি হিংসা নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দিল্লি হিংসা হয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। শারজিল কিন্তু তার এক মাস আগে থেকে জেল হেফাজতে। একে একে অসম, অরুণাচল, এলাহবাদ থেকে শারজিল জামিন পেয়েছে। মণিপুর গ্রেফতারির পরোয়ানা জারিই করেনি ফলে জামিন লাগবে না। জামিয়া-মিলিয়া মামলাতেও জামিন পাওয়া গিয়েছে। বাকি যে দুটি পড়ে রইল, তাতে প্রথমে  দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়, ৯০ দিনের মাথায় শারজিল যখন জামিনের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে এমন সম্ভাবনা তৈরি হলো, ঠিক তখন ওঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে মামলা রুজু করা হয়। এরপর আমরা নিম্ন আদালতে আবেদন করি।  আমাদের মামলা এখন দু’বছর ধরে হাইকোর্টে পড়ে আছে। ২৮ তারিখ (মে) হাইকোর্টে শুনানি।

আপনাদের আম্মা কেমন আছেন?

আম্মা স্বাভাবিক ভাবেই খুব ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু সব রোগেরই তো চিকিৎসা আছে।   আমাদের আম্মা বাস্তবটা বুঝতে শিখে গিয়েছেন।  আমাদের দেশে তো মুখ্যমন্ত্রীও নিরাপদ নন, তাকেও  যখন তখন জেলে পাঠানো হচ্ছে। এখানে যখন যা কিছু ঘটতে পারে। শারজিল তো কেউকেটা নয়, সাধারণ মানুষ। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে, আর কোনো দ্বিতীয় পথ খোলা নেই, এটা আম্মা বুঝেছেন।

শারজিল জেলে সব ধরনের সুবিধে পান?

আমি বলব শারজিল অনেকের থেকে ভালো আছে। তিহারে ২০০ জনকে এক জায়গায় থাকতে হয়। নিরামিষ খেতে হয়। শারজিল সেখানে দিনে দুটো ডিম, দুধ পায়৷ ওঁর করোনা হয়েছিল দু’বার।  আদালতের অনুমতিতে এই খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে। ওঁকে নিজস্ব ঘর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন পড়তে পারে। উমর খালিদও এই সুবিধেগুলি পান সম্ভবত।

বিরোধী দলের কোনো নেতা এই সাড়ে চার বছরে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?

কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা এই কয়েক বছরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আজ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ভাবে আমাদের সমর্থন করেননি। শারজিল-এর ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে সবার অনীহা। ব্যতিক্রম শুধু মহুয়া মৈত্র এবং ডক্টর অরুণ কুমার। এই দু’জন রাজনৈতিক নেতা শার্জিলের ব্যাপারে মুখ খুলেছেন নানা সময়ে।

আপনার কী মনে হয়, রাজনৈতিক নেতারা এই বিষয়টা থেকে কেন গা বাঁচান?

সত্যি বলতে এই ছুঁতমার্গ হঠাৎ করে আসেনি। দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্কার তৈরি হয়েছে। ২০০৮ সালের বাটলা হাউস এনকাউন্টারের কথা কি আপনার মনে আছে? অনেকেই বলেছিল ওই এনকাউন্টারটা আসলে সাজানো। বহু যুবক যাঁরা কংগ্রেস আমলে ইউএপিএ মামলায় জেলে গিয়েছিলেন,  ১০-১২ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর আজ নির্দোষ হিসেবে জেল থেকে  বেরিয়ে আসছেন। ফলে, এমন নয় বিজেপি এই কাজ প্রথম করছে। আমার মতে, বিজেপি কংগ্রেসের পদাঙ্ক নিজের মতো করে অনুসরণ করছে। 

প্রতিতুলনা চলে না, তবু যেন অন্যদের থেকেও শারজিলের ব্যাপারে নীরবতা বেশি।  কুষ্ঠরোগীর সঙ্গে যে সামাজিক আচরণ করা হতো একসময়ে, অনেকটা যেন সেই ধরনের আচরণ দেখতে পাই। রাজনৈতিক নেতাদের শারজিলের ব্যাপারে অনীহার বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?

আসলে আমাদের সমাজ বাইনারিতে বিশ্বাস করে। হয় তুমি ডানপন্থী নয় বামপন্থী। শারজিল কোনো দলদাস ছিল না। ও কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। ভিন্নতর ভাবনা তুলে ধরেছিল। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ও সমাজের সমস্যাগুলি নিয়ে কথা বলত, সমাজ পরিবর্তনের কথা বলত। সাধারণ মানুষ যে বিষয়গুলি জানতে পারে না, দেখতে পায় না, তা নিয়ে কথা বলত। অন্ধকারে আলো ফেলত।

একটা উদাহরণ দিই। ও বলত, একটা নির্বাচনে একজন ৩০ শতাংশ ভোট পেল। বাকিরা ২৩ শতাংশ করে ভোট পেল। আমাদের নিয়ম অনুযায়ী যে বেশি ভোট পেল সে জিতল। শারজিলের প্রশ্ন যাঁর বিরুদ্ধে ৭০ শতাংশ ভোট পড়ল সে কি করে জয়ী হয়! নরেন্দ্র মোদিকে দেশের ৪০ শতাংশ লোক ভোট দিয়েছে। তার মানে তো সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক তাঁকে ভোট দেয়নি। ‘১০০ কোটির জনাদেশ’ কথাটা কী করে বলেন মোদি, এটা ছিল শারজিলের প্রশ্ন।

তিহারে কী ভাবে সময় কাটান শারজিল?

শারজিল খুব অলস। এমনিতে রান্নাবান্না করতে চাইত না। কিন্তু জেলে এমন নানা কিছু করে যা বাইরে ও করত না। লস্যি বানিয়ে খাওয়ায় অনেককে। মাকে সেইসব গল্প বলে।  অসমে যখন ছিল অসমিয়া ভাষা শিখেছে। জেলে উৎসাহীদের উর্দু ও অন্যান্য ভাষা শেখায় ও। আগে থেকেই ও বাংলা শিখে নিয়েছিল। জেলে বহু মানুষকে আইনি লড়াইয়ে সাহায্য করে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রাখে। 

আজ নয় কাল বন্দিত্ব শেষ হবেই। তারপর? শারজিল রাজনীতিতে আসতে চান না?

আমার বাবা জনতা দল ইউনাইটেডের বিধায়ক ছিল। শারজিল কখনও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসতে চাইত না। বাবার মৃত্যুর পর ২০১৭ সাল থেকে আমি চাকরি ছেড়ে জনতা দলের হয়ে কাজ করতাম। শারজিলই আমায় ইন্ধন দিয়েছিল। আমি এখন আর কোনো দলীয় রাজনীতি করি না। তবে রাজনীতির খবরাখবর রাখি। এদিকে শারজিল আজকাল বলছে, রাজনীতি না করলে জেলে পচতে হবে। আমি জানি ও বেরিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেবে। কোন দলে জানি না। শারজিল প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসবেই।

ভোটের খবর রাখছেন শারজিল? জয় পরাজয়ের ব্যাপারে ওঁর কোনো মতামত আছে?

শারজিল সব খবর রাখে। আমাদের চারপাশে অনেকেই মনে করে মোদি সরকার পড়ে যাবে৷ শারজিল মনে করে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপি পাবে না। শরিকদের নিয়ে ভাঙাচোরা, দুর্বল এনডিএ সরকার তৈরি হবে।

Arka Deb

About Author

You may also like

Interview

Prominent young IG Advisor rejects future of Pro-India or Pro-Pakistan politics in Bangladesh

Mahfuj Alam’s mysticism and thought process have become some of the most talked-about topics in post-uprising Bangladesh. A strategist and
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন ২০২১- সুরজিৎ সেনের সঙ্গে কথাবার্তা
Interview

পশ্চিমবঙ্গের  নির্বাচন ২০২১- সুরজিৎ সেনের সঙ্গে কথাবার্তা

এই কথাবার্তা একধরনের জুয়াখেলার মতো অথবা নিম্নচাপের পূর্বাভাস দেওয়ার মতোই। ফল না জেনে একটি ঘটনাপ্রবাহের ময়নাতদন্ত, হাইপোথেটিকাল জুয়াচুরি। অ্যানার্কিস্ট বন্ধু

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.