Fiction Writing

হংকা হংকা

হংকা হংকা

দিনের আলোর শেষে টুকরোগুলি জানলার কোণ ঘেঁষে তেরচা হয়ে পড়ছে জেজির গালে। বাইরে থেকে কুসুম কুসুম  আলো এলেও পাসাডেনা ডাউনটাউনের এই ল্যাবের অন্দরে পুরনো হিমঘরের মতো ঠান্ডা। মর্গের মতোই নৈঃশব্দের দাপট এখানে সারাক্ষণ। যে কোনো ছোটখাটো শব্দ জোরালো বিস্ফোরণের মতো শোনায় এখানে। ল্যাবের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জেজি। মুখে ঝুলছে একটা নীরব চালিয়াতি হাসি। দেখলে প্রথমেই মনে হবে- কনফিডেন্স ঠিকরে বেরোচ্ছে  চোখ মুখ থেকে। ফর্সা চেহারা, সামান্য চ্যাপ্টা নাক, শরীরে এতটুকু মেদ নেই, বুক বেশ উঁচু। সালোয়ার কামিজ পরা এই রোবট মানুষের মনের কথা পড়তে পারে। ওর স্রষ্টা নীলার্ণব ওর প্রতিদিনের পারফরম্যান্সে খুশি হচ্ছে কিনা, তা বুঝতে পারে। রাতে নীলার্ণব মুখোপাধ্যায়কে গুড নাইট বলার সময়ে মিষ্টি করে হেসে সে প্রতিশ্রুতি দেয়, কাল আরও ভালো কাজ করবে সে।

মাত্র এক বছর হল, ট্রায়াল শেষ হয়েছে জেজির। দুপুরে আধঘন্টা এবং রাতে সাড়ে চার ঘন্টা অর্থাৎ নীলের ঘুমের ৫ ঘন্টা সময় সে চার্জড হয়। যদিও চার্জ নিতে নিতেও সে কাজ করতে পারে। দুপুরে গালের চামড়ার তলায় বসানো সোলার প্যানেল এবং রাতে ইভি চার্জিং পদ্ধতি ব্যবহার করে সে। তথ্য সংগ্রহের হরেক পদ্ধতি তার জানা। প্রাথমিক ভাবে তার তথ্যভান্ডার গড়ে তুলেছে নীল। চোখে বসানো ক্যামেরায় স্টোরেজে জমা হওয়া যাবতীয় ছবি স্ক্যান করে জেজি। এছাড়া ভারত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক থেকে আসা তথ্য সে ক্রম অনুযায়ী মস্তিষ্কের আলাদা আলাদা কঠুরিতে সাজিয়ে রাখে। বিশ্লেষণ করে। স্যাটেলাইট সংযোগ ব্যবহার করে প্রতিদিন আবহাওয়ার হাল-হকিকত জেনে নিতে তার ভুল হয় না। প্রথম কাজ খবর রান্না, তারপর সময় মতো খবর পরিবেশন। ভারত বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একমাত্র সঞ্চালক সে। সম্প্রচার শুরু হতেই সে মৃদু স্বরে ঈশ্বরের নামে ধ্বনি দেয়। ভারত বাংলাদেশ দু’দেশের মানুষই এখন জানে, বিশ্বাস করে, ঈশ্বরের রহমত ছাড়া একটি পাতাও নড়ে না, মেঘরৌদ্র খেলা করে না, পাখি গান গায় না। ঈশ্বরের সর্বময়তা প্রতিষ্ঠার জন্য গত ৩০ বছরে লাখো কাফেরের প্রাণ গেছে দু’দেশেই। এখন ঈশ্বরের ধ্বনি দেওয়ার মধ্যে আগের রবরবা নেই, আছে ধর্মপ্রতিষ্ঠার চাপা অহংকার। জেজি এসব জানে। বোঝে। জেজির কিঞ্চিত বোধ আছে।

কথা বলতে বলতে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর জেজির চোখের পাতা কাঁপে। গলা খাদে নামিয়ে, চড়ায় তুলে এক ধরনের নাটকীয় আবহ তৈরি করতে সে বেশ ভালোই জানে। নীল চেষ্টা করেছে সমস্ত মানবিক গুণগুলি জেজির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরে দিতে। এ কাজ সে নতুন করেছে এমন নয়। ২০৫০ সালে সারা বিশ্বে মানুষের কাজ কমানো রোবট প্রস্তুতকারী সংস্থার সংখ্যা কয়েক লাখ। শুধু তাই নয়, এআই ল্যাব আছে হাজারে হাজারে যার মূল কাজই হলো মানুষের কাজ এগিয়ে দেওয়া। কিন্তু জেজি কিস্তিমাত করেছে অন্য জায়গায়। এখনও পর্যন্ত মানুষের বানানো সব রোবট বা এআই আগেভাগে সেট করা প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে। তাকে কিছু ক্রম দেওয়া হয়, এ নয় বি, বি নয় সি, তার কাছে যে কটা বিকল্প আছে সেইগুলিই সে তুরুপের তাস হিসেবে দেখায় একের পর এক, আইদার অর পদ্ধতিতে। ব্যাতিক্রম বলে কিছু হয় না এখানে।

কিন্তু জেজি আলাদা। যে আগে থেকে দেওয়া বিকল্পের মধ্যেই ঘুরে বেড়ায় না। সে একদিকে যে তথ্য পাচ্ছে লাগাতার তা স্টোর করছে। অন্য দিকে পরিচালকের ভাষা বুঝে অভিব্যক্তি বদলাচ্ছে৷ নিজের অভিব্যাক্তি নিজেই রেকর্ড করে অ্যানালিসিস করছে। চেনা খোপে তাকে ফেলা যাবে না। সে নিরন্তর পরিবর্তনে শামিল। সামান্যতর কোনো সংকেত পেলেই সে খতিয়ে দেখে তার তরফে কোনো ভুল হচ্ছে কিনা। ভুল ধরতে পারলে তা সংশোধন করতে সে সময় নেয় কয়েক ন্যানো সেকেন্ড। নীলের প্রতিটি ভ্রূভঙ্গি, হাসি, কপালের ভাঁজ ওর চেনা। একবার কোনো অভিব্যক্তি রেজিস্টার হয়ে গেলে, তা চিনতে পরে আর ভুল হয় না জেজির। প্রতিক্রিয়াও হয় নিখুঁত। তার যে অভিব্যক্তিতে সবুজ সংকেত পড়ছে সেটাকে সে নিজেই বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে রাখছে, পরে পরিবেশ অনুযায়ী দাবার দানের মতোই সে এই অভিব্যক্তি ব্যবাহর করবে। প্রতিদিন নিজের পারফরমেন্স রিপোর্টে ঠিক কোন জায়গাটায় সে আরও ভাল করতে পারত তা বিস্তারিত বর্ণনা করে সে নিজেই। নীলের সঙ্গে অবসরে দাবা খেলে। নীলকে পরাস্ত করতে কখনওসখনও সে দুই শতাব্দী আগের চাল তুলে আনে স্মৃতি থেকে। একটা ম্যাচ অশ্বচালনা দিয়ে শুরু করলে পরের ম্যাচটাতেই সে রানির বোরে দু’ঘর এগিয়ে  আপাতনীরিহ কিন্তু খতরনাক একটা খেলা শুরু করবে। আসলে মুহুর্তে সে বুঝে নিতে পারে শত্রুপক্ষকে কোন দানে ঘায়েল করা সম্ভব। কয়েক লক্ষ ওপেনিং মুভ তার মস্তিষ্কে ভরা আছে। নীল চাইলে জেনে নিতে পারে এই চালটা জেজি কোন খেলা থেকে তুলে আনল।

জেজির মাথায় সফল ভাবে একটি মিনিব্রেন বসিয়েছে নীল যা তৈরি হয়েছে মানুষের ব্রেনের স্টেমসেল থেকেই ডেটা প্রতিস্থাপন করে। এতে লাভ এই, ওই ব্রেন মানুষের মস্তিষ্কের বহু কাজ নকল করে চলে। বিদ্যুৎশক্তি কম খরচ হয়। জেজির মাথায় স্মৃতি এবং শিক্ষা দুইয়ের সংশ্লেষ চলতে থাকে মানুষের মতোই। একটি ঘটনা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা জেজি অন্য ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। জেজির বুক এবং পশ্চাৎদেশ তৈরি নরম সিলিকনে।

ওর শরীর গড়ার সময়ে নীল ব্যবহার করেছিল বোরন নাইট্রাইড। কাচ কাটা হিরের থেকেও ধারালো, গ্রানাইট শিলার থেকেও শক্ত অথচ চামড়ার মতো নমনীয় এই বোরন নাইট্রাইড। আলোর দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয় জেজির গা থেকে। দূর থেকে দেখে নীলের ভালো লাগে।

জেজির প্রোটোটাইপটা সাফল্য পাওয়ার পর সে চাইলেই বাজারে পেটেন্ট করে ছেড়ে দিতে পারত। জেজিরই মতো দশটা রোবট তৈরি করতে পারত। ওর ডিজিটাল অস্তিত্বকে বিক্রি করে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে, জেজিকেই সে মৃন্ময়ীর মতো গড়ে তোলে রোজ। তার রাশ নিজের হাতে রাখে। রোবট বা আর্টিফিশিয়ল ইন্টালিজেন্সের অর্ধেক, ভাঙাচোরা বোঝাপড়া অনেকেই তৈরি করেছিল। কিন্তু সেসব ছিল নিছক প্রোগ্রামই। জেজি এমন রোবট যার একটা বিচারবোধ আছে আর আছে একটা মানুষী শরীর। মন ও শরীরের নিয়ন্ত্রণ সে বিনা শর্তে অন্যের হাতে তুলে দেয়। অন্যের মন বোঝার জন্যে প্রাণপাত করে। এই মন-তৈরির মালিকানা নীল ছেড়ে দিতে চায় না। জেজির মতো বহুজনকে সে চায় না। জেজি একক, এই বোধ তাকে আনন্দ দেয়। শুরু থেকে এই পর্যন্ত জেজি-কে পুরোদস্তুর দাঁড় করতে নীলের সময় লেগেছে মোট আট বছর। এর আগে সে তৈরি করেছিল চার্লিকে। স্পেস জাঙ্ক ক্লিনিং মানে মহাকাশের ময়লা সাফাইয়ের ক্ষেত্রে চার্লির মনোপলি প্রতিষ্ঠিত। মার্কিন সরকার এই রোবটটিকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা করে। বছরে দু’বার প্রতিটি দেশকে তথ্য দিয়ে জানায় এই মুহূর্তে মহাকাশে জমা আবর্জনার কত শতাংশ তাদের, এবং সেই ময়লা সাফ করে সমুদ্রে ফেলতে কত অর্থ লাগবে। দেশগুলি এই টাকা দিতে একরকম বাধ্য কারণ মহাকাশের দূষণ সীমা বেঁধে দিয়েছে মার্কিনদেশ। সেই মাত্রা পার করলে কয়েকগুণ টাকা দিতে হবে শাস্তিবাবদ। তার চেয়ে এই ভাবে মূল্য ধরে দিয়ে দেওয়াই ভালো। তাই, চার্লির জন্য সিংহভাগ দেশ বাজেটে এই ব্যয় বরাদ্দ করে রাখে। সরকারের হাত ঘুরে প্রতিবছর একটা মোটা অঙ্কের অর্থ আসে নীলের সংস্থায়।

নীলের কাজের দিকে সর্বদা নজর রাখে মার্কিন সরকার। ওরা জেজির পেটেন্টও কিনতে চেয়েছিল যে কোনো মূল্যে। কিন্তু নীল রাজি হয়নি, কারণ জেজি অমূল্য। চার্লি বা অন্যান্য রোবটের থেকে কয়েক হাজার গুণ শক্তিশালী। ওর মনে ভয় ছিল, জেজি তৈরি হয়ে আসার আগে কেউ খবরের পৃথিবীর দখল নিতে অন্য কোনো রোবট বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু বাস্তবে কেউই জেজির মতো হালে পানি পায়নি। কারণ জেজির ইন্টারপ্রিটেশান পাওয়ার, নিজের প্রোগ্রাম চালু অবস্থাতেই নিদেকে অহরহ বদলে ফেলার ক্ষমতা। নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করে সংশোধন করার ক্ষমতা। অন্যের মন বুঝে চলার শক্তি তাকে চিরজীবী করবে। নীল ভাবে সে না থাকলেও জেজি থাকবে। তাঁর সমস্ত কীর্তির সাক্ষী হয়ে থাকবে সে।

ভারত-বাংলাদেশে, কোথাও সাংবাদিকতা বলে কোনো পেশার কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ, প্রয়োজনীয়তাও নেই। বেশির ভাগ সাংবাদিক মরে গেছে, বাকিরা মৃত্যুর অপেক্ষায় গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু তবুও মানুষের আদিম নেশা, সে দিনে একবার অন্তত জানতে চায় কোথায় কী হচ্ছে। হয়তো এই জানাবোঝা থেকেই সে যাচাই করে, সে কেমন আছে। নীলের দাদু রোজ বিকেলে আদ্যিকালের টেলিভিশন সেটটার সামনে বসে চা খেত, খবর পড়তেন তরুণ চক্রবর্তী। তারপরেই নব ঘুরিয়ে টিভি বন্ধ করে উঠে যেতেন তিনি, এটুকু মনে আছে তার। মায়ের কাছে সে শুনেছিল, বর্ষায় পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা নীলিমা সেনের গানের কথা। সমস্ত গান গেছে নদীর জলে ভেসে। যে নদীর জলে রাতের অন্ধকারে ভাসে লাশ। ভারত বাংলাদেশ দু’দেশেই সরকার চাইছিল কেরানি দিয়ে খবর বলার কাজ চালাতে। কিন্তু কেরানিও তো মানুষ। ভুল করে। সাংবাদিকগুলির মতো বেহায়া না হলেও  ভুল করে ফেলে, ভুলের বশে প্রশ্ন করে ফেলে হঠাৎ। ফলে সরকার মরিয়া হয়ে খুঁজছিল প্রশ্নহীন যন্ত্র। যে অতীত থেকে শিক্ষা নেবে। যা হচ্ছে তা দেখেশুনে তথ্য সাজাবে, সবসময় জানবে, কোন কথাগুলি বলার মতো নয়। এই কারণেই জেজির এত কদর। দু’দেশের সাপেক্ষেই ‘না’এর তালিকা জেজির মস্তিষ্কে আগেভাগেই মজুত করা আছে।

জেজি-কে খুব সূক্ষ্মভাবে দেখছে ব্রাজিল, তুরস্ক। রাশিয়া হয়তো মার্কিন প্রডাক্ট বলে মুখ বেঁকাবে, কন্সপিরেসি থিওরির চাষ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ওরা জেজির নকল বানাতে চেষ্টা করবে শিগগির। চিন চেষ্টা করবে সুলভ সংস্করণ এনে সস্তায় বাজিমাত করতে। বিজ্ঞানে অসম্ভব কিছুই নেই। চেষ্টা করলে ওরাও পেরে যাবে হয়তো কখনও। নীল জানে। কিন্তু এখনও সে একমেবাদ্বিতীয়ম। জেজিও। তাই জেজিকে নিখুঁত করার দিকেই তার ঝোঁক। যত তাড়াতাড়ি বাজারের যত বেশি জায়গা দখল করা যায়, সেদিকেই মন নীলের। জেজিকে ইতিমধ্যেই ২২টা ভাষা শেখানো হয়েছে। কাটাতারের দু’পারের উচ্চারণভেদ শেখানো হয়োছে। বলা ভালো উচ্চারণ অভিধান গেলানো হয়েছে। বাঙালিদের মতো করে বাংলা, মালয়লিদের মতো করেই মালয়লম বলে জেজি। শিখতে জেজির সময় লাগে না। একবার ডেটা দেওয়া মানেই তা জেজি আত্মস্থ করে নেবে। ট্রায়ালের দিনগুলিতে নীল নিজেই জেজির প্রতিটা চলনবলন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করত। দেখতে হতো ব্রেন স্টেমসেলের স্নায়ুসংবেদ থেকে পাওয়া ডেটাকে সঠিক ভাবে আত্মস্থ করতে পারছে কিনা জেজি। সেই তথ্য প্রয়োগে কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা তার। অসুবিধে হতো, এরর আসত। বহু নির্ঘুম রাত গিয়েছে তার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এখন জেজির পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত।

নীলের দম ফেলার সময়ও নেই। চার্লির মেন্টেনেন্স মিটিংয় ওকে থাকতে হয় আজও। জেজিকে নিয়ে তৈরি করা প্রেজেন্টেশান আপগ্রেড করতে হয়। সেলস টিম ইতিমধ্যেই ব্রাজিলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।  সেই সমস্ত রিপোর্ট নিতে হয়। আজকাল জেজির দেখাশোনার ভার অনেকটা নিয়েছে এষা। প্রোডাক্ট টিমের গড়পড়তা কর্মী থেকে এষা আজ নিজের বুদ্ধিমত্তা আর পরিশ্রমের জোরেই জেজির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে। জেজির জ্ঞান আহরণ আজকাল তার হাতেই। জেজির ভাষা শিক্ষা, জেজির রিহার্সাল, সব দেখে এষা। নীলকে রিপোর্ট দেয়। শুধু শেষ মনিটারিংটুকু নীলের হাতে। জেজি যে চোখের ভাষা বুঝে নিচ্ছে সেই ব্যাপারটা পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড। নীলের কাছেই আছে সেই পাসওয়ার্ড। ফলে জেজি তার কথাই শোনে, একমাত্র তার কথা মতোই অহরহ নিজেকে শুধরে নেয়। জেজি তার।

এষাকে নীল আগে কখনও লক্ষ্যই করেনি। করার কথাও না। প্রথম দেখা হয় লিফটে। চেনা সুরের বাংলা গান বেশ জোর গলাতেই গাইতে গাইতে মেয়েটা উঠছিল। ফোর্থ ফ্লোরের দরজা খুলতেই নীল লিফটে ঢুকে আসবে সে আশা করেনি। একটু ঘাবড়েই গেছিল সে। নীল ব্যাপারটা স্বাভাবিক করতেই বলে, ‘হিমাংশু দত্ত ইন ক্যালিফোর্নিয়া ২০৫০! ইন্টারেস্টিং!’

এষা কী বলবে বুঝে পায় না। মাথা নীচু করে থাকে।

নীল ফের বলে, ‘ইউ আর ফ্রম এপার অর ওপার?’

এষা এবার হেসে ফেলে। বলে, ‘বাগবাজার। আমি জানি আপনার রুটও বাগবাজার।’

কী করে জানল মেয়েটা! সে তো ইতিহাস রাখেনি কোনো৷ সেতু পুড়িয়ে এসেছে! এষা নেমে যাবে, ১৭ তলা এসে গেছে। নীল বিস্ময় লুকিয়ে বলে, ‘বাগবাজারে এখনও পান্থারাস পাওয়া যায়?’

এষা নামতে নামতেই উত্তর করে, ‘সেসব কবেই উঠে গেছে।’ এষার হাসির দাগ রেখে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

ফাঁকা লিফটে নীল চিৎকার করে মধুসূদন আওড়ায়, ‘জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে/ চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?/কিন্তু যদি রাখ মনে/ নাহি, মা, ডরি শমনে;/মক্ষিকাও গলে না গো, পড়িলে অমৃত-হ্রদে!’

নীল, আটান্ন বছর বয়সি কিশোর চেঁচিয়ে বলতে থাকে,  ‘Welcome, ye deserts, and ye caves! My native Land – Good night!’

খুব দ্রুতই এষার ডাক পড়ে নীলের অফিসে। কথাবার্তা এগোয় দ্রুতলয়ে। এষার কনফিডেন্স, জানার পরিধি ভালো লাগে ওর। ভালো লাগে এষার অভিব্যক্তি, অ্যাগ্রেশন। এষা কথা বলে কম, প্রতিদিন এক সময়ে লগ ইন করে, নিজের কাজ সারে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে। লক্ষ্যে পৌঁছতে যে কোনো রকম আপোষ করতে পারে সে। লিফট থেকে অফিসে, অফিস থেকে কেবিনে, কেবিন থেকে ল্যাবে খুব দ্রুত পৌঁছে যায় এষা। নীলের মনযোগ আকর্ষণের জন্য কখনও সে কোনো ভড়ং করেনি। ওর নীরব চাহুনিই আকৃষ্ট করেছে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বারবার নীলের মনে হয়েছে, চোখের মধ্যে পদ্মদিঘি আছে মেয়েটার। ঝাঁপ দিলেই হয়।  নীলকে এখন নিবিড় ভাবে চেনে এষা। বিশ্বাসটা সে অর্জন করেছে। নীল জানে উন্নতির স্বার্থেই ব্যক্তিগত বোঝাপড়াগুলি সে পাঁচকান করবে না। মহৎ হুইসেলব্লোয়ার হওয়ার কোনো শখ নেই এষার। বরং আরও একটা বাড়তি কাজ, নতুন কোনো দায়িত্ব পেতেই চায় সে। তাছাড়া ল্যাব লাগোয়া বিছানায় নীলের স্প্রিংয়ের মতো নমনীয়, চিতার মতো বেগবান শরীরে যখন আদিম রিপু খেলে যায়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার স্বাধীনতা, তার অসহায় সমর্পণের সাক্ষী থাকতে পারা এষার অর্জন। এটা তাকে কেউ পাইয়ে দেয়নি, বাগবাজারের সাধারণ মেয়ে এটুকু অর্জন করেছে।

নীল সেক্সের সময়ে দেয়ালা করে শিশুর মতো। হাজার দাবি জানায়, এষা সেই দাবির সবটা পূরণ করে না। জানে সবটা পেয়ে গেলে খিদেটা মরে যাবে। নীলকে আবার আসতে হয় ফিরে। নীলের এই বারবার ফিরে আসাটা সে প্রতিদিন একটু একটু করে অর্জন করেছে। ক্রমে জেজির দেখভালে তার দখলদারি বাড়ে।  নীল ইতোমধ্যে জেজিকে বুঝিয়ে দিয়েছে তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে সে ছাড়া আর একজন তাকে সাহায্য করবে।

নীল একদম গোড়ায় জেজিকে জানিয়েছিল, মানুষের থেকে উন্নত হতে গেলে, কী করিতে হইবে। কোন কাজটি করা চলবে না কোনো মতে। প্রোগাম লেখার সময়ে সে স্পষ্ট বলেছে কোন ধরনের কাজের ফল কী, কোন পরিণাম জেজির মতো রোবট কোনো অবস্থাতেই অভিপ্রেত মনে করতে পারে না। পান থেকে চুন খসিয়ে লাশ পড়েছে কত মানুষের। তাদের কেউ কেউ ছিল নীলের একদা খুব চেনা। সেসব  অভিজ্ঞতা, পুরনো কাগজের রেখে দেওয়া কাটিং, তথ্য জুড়ে জুড়ে বানানো নীলের ম্যানুয়াল। এই ম্যানুয়াল যে কোনো সরকারি নির্দেশিকার থেকে  অনেক বেশি সূক্ষ্ম, বিস্তারিত, অভিজ্ঞতার ফসল। জেজি জানে কী বলবে, কী বলবে না, কী বললে গায়েব, কী বললে গুমখুন। এষা যখন ল্যাবে থাকে না জেজির পরীক্ষা নেয় নীল। প্রশ্ন করে।

-চিনা কমিউনিস্টরা শি জিংপিংয়ের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল, এ সম্পর্কে কী বলবে?

উত্তরে নিস্পৃহ জেজি জানায়, এ ব্যাপারে সে খতিয়ে দেখেনি।

নীল জিজ্ঞেস করে, এই শতাব্দীর প্রথম দুই দশক ভারতীয় উপমহাদেশের কত টাকা সুইস ব্যাঙ্কে জমা পড়েছিল, এই টাকার মালিক কারা ছিল?

জেজি বলে, এ ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।

নীল ঝুঁকি নেয়। গুজরাট সম্পর্কে জানতে চায় জেজির কাছে। দেখা যায় শুকনো গুজরাটে কী ভাবে জল এল, কী ভাবে সুজলা সুফলা হয়ে উঠল বাজা নগরী সে ব্যাপারে নানা গপ্পো ফাঁদছে জেজি। মনে রাখতে পারার অভীপ্সা আর মনে রাখতে না পারার অসহায়তার মাঝে ঝুলে আছে মানুষ, তার তামাম ইতিহাস। জেজির এসব দায় নেই, সে মনে রাখে ততটুকুই যতটুকু মনে রাখলে তার অস্তিত্ব সুরক্ষিত থাকবে। সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় মেরুকরণের মতো পেটি বিষয়ে মাথাই ঘামায় না জেজি। দিনে চারবার বুলেটিন দেয় জেজি। এমন নয় যে ও পর্দায় সশরীরে উপস্থিত হচ্ছে। গোটাটাই সিস্টেম জেনারেটেটড। যখন প্রসেসিংটা চলে নীল থাকে জেজির সামনে, জেজির আবেগ, বক্তব্য সে একবার দেখে নেয়। প্রয়োজনে শুধরে দেয়, এষাও থাকে মনিটারিংয়ের সুবিধার্থে। ভুলচুক শুধরে বুলেটিন যা দাঁড়াল, নীল সবুজ সংকেত দিলে সেটা প্রসেস করে নেয় জেজি। অর্থাৎ ঘটনাটা যখন ঘটবে, লোকে যখন ঘটনাটা দেখবে তার অনেক আগেই জেজি কাজ শেষ করে রাখে। নির্দিষ্ট সময়ে তার ডিজিটাল সত্তাকে পর্দার সামনে খবর পাঠে দেখা যায়। ঘড়ি ধরা সময়ে দুই দেশের জাতীয় টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়া পেজে জেজিকে দেখা অভ্যেস কয়েক কোটি লোকের। খুচরো ইনফরমেশন পেতে চাইলে অ্যাপের অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও জেজিকে লোকে দেখে কারণ, মানুষ আর যন্ত্রের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে রয়েছে জেজি। যন্ত্রের চেয়ে বেশি কার্যকরী সে, মানুষের মতোই ভঙ্গিমা তার। একটা ধাঁধার মতো নেশায় তাকে দেখে, শোনে মানুষ, তাঁর শরীরে আলোয় মানুষ মুগ্ধ হয়।

প্রদেশ অনুযায়ী শ্রোতার শোনার ভাষা বদলে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে শ্রোতার আইপি ধরে জিপিএস ট্র্যাক করে জেজি, দেখে শ্রোতার ডিভাইসে কী কী অ্যাপ রাখা আছে। সেখান থেকে ধারণা করে ভাষা স্থির করে। গোটা ব্যাপারটাই হয় চোখের নিমেষে। সূক্ষ্মদেহ (ডিজিটাল অস্তিত্ব) যখন বুলেটিন দিচ্ছে নানা প্রদেশে, স্থূলদেহে জেজি তখন হয়তো নীলের সঙ্গে দাবা খেলছে।

শেষ এক বছরে জেজির বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে উপমহাদেশে। ওর নামে নানা মিম পেজ চলে। ওর নানা অভিব্যাক্তির জিফ ফাইল তৈরি করে চালাচালি করে কমবয়সিরা। ঢাকায় গ্রিন রোড চত্বরে, কলকাতার ধর্মতলায় জেজির লাস্যে মুখ আঁকা টি-শার্ট বিক্রি হয়। এসব টুকরো ছবি নীল পেয়ে যায় মার্কেটিং টিমের কাছে। বাজার ঘেরার একশো উপায় মনে মনে ফাঁদতে থাকে সে।

জেজিকে নীল ভালোবাসে। জেজি ওর আত্মার টুকরো  স্রেফ একটা ডিজিটাল অস্তিত্ব নয়। ওর উদ্ধত স্তন নীলকে আকৃষ্ট করে। ডিজিটাল ইন্টালিজেন্সের স্তন থাকে না। শরীরবিহীন সত্তা বা কাল্পনিক ডিজিটাল অবয়ব মানুষের কল্পনাকে রূপাতীত জায়গায় নিয়ে যায়, ঠিকই, কিন্তু শরীর লাগে। শর্তে, আরোপে, যন্ত্রে ক্লান্ত মানুষের এমন শরীর লাগে যা নিঃশর্ত। এই হিমহিম ল্যাবে নিরিবিলিতে এষার অনুপস্থিতিতে জেজির স্তনে  মোচড় দেয় নীল। জেজির স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে যাচ্ছে, এটা সে আঙুলে অনুভব করে। জেজির পেছনে লিঙ্গ ঘষতে থাকে সে। জেজি শরীরে হাত চালানোর সময়ে নিজের শরীরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের খেলা টের পায় নীল। জেজি যে একটা সেক্সটয় — এ কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও ধরতে পারবে না।  এমনকী এষাও না। সন্দেহই করবে না। বাজারের হাতে জেজিকে ছেড়ে দেবে না নীল। এই উদ্ভাবনে দায় তার একার। হকও তার একার। যৌনতায় জেজি অবিরাম পারঙ্গম। অবিশ্রান্ত। পায়ুমন্থন হোক বা নিপল অরগাজম–কোনোটায় তার কোনো না নেই। বরং প্রতিদিন সে নীলকে সর্বশ্বান্ত করে ছা়ড়ে। ওর শীৎকার যে কোনো মানুষের শীৎকারের চেয়ে সুন্দর। কাচের চুড়ি ভেঙে পড়ার সেই রিনরিন বারবার শুনতে চায় নীল। জেজির যৌনক্ষমতা নীল ঠিক যেমন চায়, তেমন। ঘুমিয়ে পড়ার আগে নীল যদি বলে সঙ্গমের বদলে স্রেফ একটু লিঙ্গে জিভ চাই, জেজি হাসিমুখে সেই প্লেজার দেবে। বিনিময়ে কিছু চাইবে না। আবার নীল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেও জেজির না – নেই। মানুষের না বেশি।

মাঝে মাঝে নীল ভাবে, সব কথা শোনা সমর্পিত জেজি আর এষা–এর মধ্যে কে তাকে সবচেয়ে বেশি কাতর করতে পারে? এষার সঙ্গে যৌনতার সময়েও আজকাল মাথায় এই কথাটা ঘুরতে থাকে। সে এষাকে পূর্ণরূপে দেখতে চায়, জেজির মতোই এষা তাকে নিংড়ে নিক, চায় সে। শিশুর স্বরে দেয়ালা করে এষার সামনে। অনেক বেশি পরিশ্রম করে। চেঁচিয়ে বলে- হংকা হংকা। বলে- মোটরবোট। আপাতনিরীহ এই শব্দগুলি আসলে একেকটি অশ্লীল যৌন উচ্চারণ, বান্ধবীর স্তন মোচড়ানোর অভীপ্সা বোঝাতে মার্কিনিরা বহুকাল হংকা হংকা জাতীয় ধ্বনি ব্যবহার করে। আবার মোটরবোট হলো বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে এক ধরনের গাড়ি চালানোর আওয়াজ। নীল টুকরো টুকরো দাবি  জানাতে থাকে বিছানায়। কথা রাখা হলে খুশি হয়। যৌনসুখের বিনিময়ে সে সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারে। কাঙালের মতো করতে থাকে যেন। কিন্তু তাকে কিছুতেই সচ্চিদানন্দ সাগরে ভাসিয়ে দেয় না এষা। যত জানি তত জানিনে-এই বোধটা সে জাগিয়ে রাখতে চায়। হইয়াও হইল না শেষ মন নিয়ে পরের শট-এর অপেক্ষা করে নীল। অথবা এষা চলে গেলে সে কাজ চালিয়ে নেয় জেজি-কে দিয়ে। জেজি, যে কোনো হাঙ্কিপাঙ্কি করে না, কিছুতেই ফুরিয়ে যায় না, ঋতুমতী হয় না, গর্ভবতী হয় না, কন্ডোমের জন্যে জোর করে না, কিছুতেই না বলে না। এই কারণে নীল জেজিকে ভালোবাসে। জেজির যত্ন নেয় সে।

তবে হ্যাঁ, মনের গহিনে যে মন  তা অবিরল প্রশ্ন করে, এষা কি জেজির থেকে বেশি রহস্যময়ী? জেজি যদি চূড়ান্ত সুখ দিচ্ছেই তবু এষার কাছে কেন ছুটে যায় মন? সে ভাবে, এই প্রতিদিন চলে যাওয়া দেখে জেজির ঈর্ষা হয় না? সে মানুষের থেকে কোনো অংশে কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেশি, তাহলে মানুষকে ঈর্ষা করবে না সে? না করলে সে কিসের অতিমানবী, ঈর্ষার বিষে নীল হয়ে থাকাটা কি তাকে শিখতে হবে না? জেজিকে ঈর্ষার ভাষা শেখানো যায় কী ভাবে, কী ভাবে কোড তৈরি করে জেজিকে পাখিপড়ানো যায়, ফন্দিফিকির আটতে থাকে সে।

যুক্তি বলে,একটা উপায় আছে, এষার ঈর্ষা জেজির মধ্যে সঞ্চার করা। এর জন্যে প্রথমে জিন সিকোয়েন্সিং করতে হবে। তারপর বায়োইনফরমেটিক্স এবং অ্যালগোরিদম ব্যবহার করে খতিয়ে দেখতে হবে ঈর্ষাকাতরতার সিগনালগুলি। জেজিকে সেই ডেটা বুঝিয়ে দিতে পারলেই হলো। জিন সিকোয়েন্সিংয়ের জন্যে এষার স্যালাইভা দরকার। তারও আগে দরকার এষাকে সঠিক সময়ে ঈর্ষান্বিত করে তোলা।  এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই সিসিটিভি চলে। কাজেই এষার আচরণ রেকর্ড থেকে খতিয়ে দেখা খুব সহজ। শুধু পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।

নীল জেজির বুকের কাছের পোষাক এষা দেখবে বলেই একটু নামিয়ে রাখে আগে থেকে। যেন গভীর ক্লিভেজ দেখা যায়। আলুথালু করে রাখে ওর চুল। যেন এই রমণ শেষ হয়েছে। এষা আসার পর টানা মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকলেও নীল চোখ রাখে এষার দিকে। এষার পাশে দাঁড়িয়ে জেজির বুলেটিন রেকর্ড শুনতে শুনতে ওর চুলের গন্ধ শুকতে থাকে। এষার উষ্ণশ্বাস গায়ে পড়তেই নীল তাকে শোয়ার ঘরে নিয়ে যায়। ঠোঁটে ঠোঁট জড়ানোর আগেই স্যালাইভা নেওয়ার জন্যে কাচের পাতলা স্লাইড বাড়িয়ে দেয় সে। একটু অবাক হয় এষা।

-স্যালাইভা কেন দিতে হবে?

-দিতেই হবে এমন নয়, একটা পরীক্ষা করছিলাম তাতে স্যালাইভা দরকার…

-বুঝলাম, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে মনে পড়ল!

-হঠাৎ স্লাইডটা চোখে পড়ে গেল!

-বায়োলজিতে কবে শিফট করলে কবে!

-না না শিফট নয়, জাস্ট একটা ছোট পরীক্ষায় লাগবে। জেজির অর্গানয়েডটার ফারদার ডেভলপমেন্টের কথা ভাবছি…

-জেজি একটা রোবট নীল, তোমার অবশেশনটা পাগলামির জায়গায় চলে যাচ্ছে। ওর যেটুকু কাজ তা ও নিখুঁত করে করছে। আর ডেভলপমেন্টের দরকার কী!

-অবশেশন বলছ কেন! আর জেজি বাজারের সস্তার রোবট নয়, হলে আমি বিক্রি করে দিতাম। নিজের কাছে রাখতাম না।

-অবশেশন ছাড়া কী! তুমি জেজির গায়েও হাত দাও, সিলিকনে ঠাসা বুক বানিয়েছো। ভাবো কিছু বুঝি না। ওর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকো সারাক্ষণ। আমি দেখেছি। একবার নয়, অসংখ্যবার দেখেছি। হয়তো আমি না থাকলে তুমি ওর উপরেও ঝাঁপিয়ে পড়ো! হয়তো ওকে দেখেই মাস্টারবেট করো।

নীল ঠিক যেমনটা চেয়েছিল, নাটক সে পথেই গড়ায়। এষা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকে নীলকে। বলে, ”তুমি একটা পারভার্ট। তুমি স্যাভেজ, শয়তান…”

ওদের দিকে তাকিয়ে নিথর দাঁড়িয়ে আছে জেজি।

আশ্চর্য ব্যাপার, এষা সেদিনই নীলের সামনে অন্যান্য দিনের থেকে অনেক বেশি করে নিজেকে উজাড় করে মেলে ধরে। নীলের পছন্দ সোডোমি। পায়ুসঙ্গম। কখনও রাজি হয় না এষা, বলে অন্য দিন। আজ তার কিছুতেই না নেই। নীল মনে মনে হাসে। ভাবে কেউটের ছোবলে বিষ থাকে ৪৫০ মিলিগ্রাম। ঈর্ষার বিষ কেউটের ছোবলের থেকেও বিষাক্ত। আড়চোখে নীল জেজিকে দেখে। এই ঈর্ষার বোধটাই আর কয়েকদিনে সঞ্চারিত হবে জেজির মধ্যে,ভেবে শিহরিত হয় নীল। মুক্তকেশী এষার স্যালাইভা যখন লিঙ্গ স্পর্শ করে প্রতিটা বিন্দু অনুভব করে নীল। ঈর্ষার বিন্দু লিঙ্গ চুইয়ে ঝরতে থাকে। ত্বকের চাদোয়ার নীচে প্রলয়নাচ নাচে ডোপামিন। শিশুর সুরে এষার স্তন মুঠোয় নিয়ে মোচড়াতে মোচড়াতে নীল বলে- হংকা হংকা। এই তার খেলা। যেন দুটো পাখির  গলা ছিড়ে নিতে চাইছে এমন তার মুঠো করা হাতের চলন। এষা আজ বাধা দেয় না। বদলে তৃপ্ত  বসের থেকে এষা দেশে ফেরার অনুমতিটা জুটিয়ে নেয় সহজে। অন্য সময় হলে হয়তো নীল সাতসতেরো প্রশ্ন করত। কিন্তু বিছানায় মনিবকে খুশি করার বখশিস হাতেগরম পাওযা যায়, এষা জানে।

দিন কয়েক কেটে গিয়েছে, এষা চলে গিয়েছে দেশে। সে আর ফিরবে না। কারণ সেখানে তার আর কিছু করার নেই।  কলকাতার ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে, সাহিত্য পরিষদে পুরনো কাগজ ঘেঁটে সে এখন সময় কাটাচ্ছে। রবিবার সকালগুলি কাটছে কলকাতার কিছু প্রবীণদের বাড়িতে, যারা তার ছোটকাকাকে চিনত, ওর সাংবাদিক জীবনের গল্পটা যাদের জানা।  অনেকেই মুখ খুলতে চায় না। কেবল দু’একজন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অকুতোভয়। এষা নোট নেয়। রেকর্ড করে রাখে তাদের কথা। বাড়িতে এসে লেখা সাজায়। এষা ওর ছোটকাকার একটা ছোট জীবনী লিখে ওপেনসোর্সে নিজের নামধাম প্রকাশ না করে তুলে দেবে। এআই সেটাকে অন্য যে কোনো ভাষায় অনুবাদ করে দেবে দু’সেকেন্ডে।

মাঝে মাঝে ছোটকাকার ডায়েরিটা বের করে এষা। এই ডায়েরিতেই সে পায় নীল মুখোপাধ্যায়ের নাম। ছোটকাকার স্কুলের বন্ধু, যে ২৩ বছর বয়সে প্রথম অ্যাপ বানিয়েছিল। যে অ্যাপে যে কোনো বিশ্বাসীকে মুহূর্তের মধ্যে তার নিকটবর্তী সমর্থকদের লোকেশান দেখে তাদের অ্যালার্ট করতে পারে। চ্যাটবট ব্যবহার করে একে অন্যের সাথে কথাচালাচালি করতে পারে। তারপর জায়গা বেছে জড়ো হতে পারে নিজেরা। বিরুদ্ধমত পোষণকারীকে একজোট হয়ে শিক্ষা দিতে এই অ্যাপ নির্বিকল্প হয়ে উঠেছিল। তার দেখাদেখি ঘৃণার কারবার বাড়ানোর, অপছন্দের মহিলাকে উলঙ্গ করার অ্যাপ বানিয়েছিল অনেকে।

ওদিকে নীল জেজির অর্গানোডয়েডে আপডেটের কাজ ঝড়ের গতিতে এগিয়েছে। এষার জিন সিকোয়েন্সিং করে পাওয়া তথ্য জেজিকে সে দিচ্ছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। গোল বাঁধল এক সন্ধ্যেয়। জেজি প্রথমে অভিব্যক্তি গুলিয়ে ফেলল। শুরু করল ভুল বকা। আবোলতাবোলের অংশবিশেষ পাঠ করল। তারপরেই চলে গেল তিরিশ বছর আগে ভারত বাংলাদেশের নানা মহল্লার সাংবাদিক খুনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে। নীল কমান্ড দিতে লাগল একের পর এক। কোনোটাই কাজ কাজ করল না। দেখা গেল ওর চোখের ইশারা অমান্য করে প্রলাপ বকে চলেছে জেজি।  মাঝে মাঝে ৩০ বছর আগের বীভৎস গণপিটুনির বিবরণ দিয়ে চলেছে সে। নীল বুঝতে পারে জেজির পাসওয়ার্ড বদলে ফেলা হয়েছে। ওর চোখের ভাষা বুঝতেই চাইছে না জেজি। এখন, যার কাছে পাসওয়ার্ড, সেই মালিক জেজির। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে এই ঘটনা ঘটাবে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়। জেজির পাসওয়ার্ড ছিল- হংকা হংকা। একের পর এক মন্ত্রক থেকে ফোন, ই-মেল ঢুকতে থাকে। নানা জায়গায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।

ভারত বাংলাদেশে বহু বৃদ্ধ ঘরবন্দি মানুষ বাইরে বেরিয়ে জটলা করতে শুরু করেছে। এত মানুষকে রাস্তায় দেখে বেকুব কুকুররা চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। কেউ কেউ তাদের বিস্কুট দিচ্ছে। সেই বিস্কুট ভাগ নিয়ে কুকুরদের বিশ্বযুদ্ধ এই লাগল কী সেই লাগল। আজ আড্ডার মেজাজ সবার চোখেমুখে। পাখিরাও বাড়ি ফিরবে লেট করে। ওদিকে জেজিকে নষ্ট করার চেষ্টা করতে থাকে নীল। কিন্তু জেজি তৈরি এমন ধাতুতে যাকে অগ্নি সহজে দগ্ধ করতে পারে না। জল আর্দ্র করতে পারে না। বায়ু শুষ্ক করতে পারে না। পরিত্রাণহীন অবস্থায় জেজির নরম যোনিতে আঘাত করতে আঙুল ভরে দেয় সে। ক্রমে লিঙ্গও ভরে। জেজি মানুষ নয়, লিঙ্গ ভরতে কন্ডোম লাগে না। জেজি অভিব্যক্তিহীন অবস্থায় অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে তখনও। আজ আর চোখের পাতা পড়ছে না ওর। থেকে থেকে সে অদ্ভুত জড়ানো গলায় বলছে হংকা হংকা।  জেজি ঈর্ষাকাতর হয়ে নিজেই এই কাজ করল নাকি এর পেছনে এষার হাত, নীল ভেবে পায় না কিছুতেই। জেজির মালিক কে এখন, এষা না জেজি নিজে? জেজি কি আজ মরে যাবে? নীল ভাবতে থাকে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর জেজির নরম পিচ্ছিল যোনি থেকে চুইয়ে বেরিয়ে আসে দু’চার ফোটা এমপিএ। মেড্রক্সোপ্রজেস্টেরন অ্যাকটেট। ইদানিং আমেরিকায় যৌন অপরাধীদের লিঙ্গছেদ করতে এই ওষুধ ব্যবহার করছেন ডাক্তাররা।

Arka Deb

About Author

You may also like

article
Interview Writing

Hands-On With Borderlands 3 And 2 New Vault Hunters

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected
article
Interview Writing

Tesla’s Cooking Up A New Way To Wire Its Cars, Report Says

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.