গত সাতচল্লিশ দিন এই গ্রামের কোনো শিশুর কান্নার শব্দ দূর থেকে শোনা যায়নি। হঠাৎ রাতের অন্ধকার ভেদ করে মিলিটারি টর্চ অথবা আরও জোরালো কোনও জিপের হেডলাইট জ্বলে উঠতে দেখেনি কেউ।। এক ছটাক জমির জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে লাঠালাঠি, ত্রাণের চালের জন্য হইচই শোনা যায়নি। শিশুদের স্কুল বন্ধ হয়েছিল অনেক আগেই, তবু স্কুল বাড়িগুলি দিনের বেলা গমগম করত আশ্রিতদের হাহাকারে। সেই সুর মিলিয়ে গেছে শুকনো বাতাসে। রাতের অন্ধকারে হঠাৎ কারো বাড়িতে আলো জ্বলে উঠল, বাড়ির বড় ছেলেকে তুলে নিয়ে গেল বন্দুকধারীরা এমন ঘটনাও এই সাতচল্লিশ দিনে আর ঘটেনি। এমনকী সাংবাদিকরাও আর পা রাখেনি এই গ্রামে।
অথচ এমন নিস্তব্ধতা আগে ছিল না। পাথরের মত ভারী দিন আর মোষের গায়ের নিকষ কালো আঁধার এ গ্রামে একমাত্র সত্য ছিল না। আর পাঁচটা ছোট গাঁ গঞ্জের মতোই এখানকার কিছু লোক সকাল হলে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ত শহরের দিকে। কেউ কেউ মাঠে যেত মেষ চরাতে। গ্রামের ভেতর একটা উষ্ণপ্রস্রবণ ছিল। দামাল ছেলেরা সেখানে যখন তখন নেমে পড়ত। কিশোর কিশোরীরা টিলার ভাঁজে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রেমের চিঠি চালাচালি করত। অলস লোকেরা দিনভর জুয়া খেলত। ফুলের মধু চুষতে ঝাঁক বেঁধে আসত প্রজাপতি। বিকেলে ইলেকট্রিক এর তারে সার দিয়ে বসে থাকত শত সহস্র পাখি। কেউ কেউ বাড়তি মজা নিতে ঢিল ছুঁড়ে মারত পাখির ঝাঁকে, শত শত পাখি একসাথে প্রাণভয়ে পালাচ্ছে দেখলে ছেলেদের আমোদ হতো খুব। এবাড়ি থেকে ও বাড়ি আচার যেত। ও বাড়ি থেকে আসত মোরব্বা শিমুই।
এ গ্রামে লেখাপড়া জানা লোক তেমন ছিল না। ছিলেন গোলাম রব্বানি সাহেব। গোলাম রব্বানির বাড়িতেই একমাত্র কাগজ আসত। গোটা গ্রাম বিশ্বের খবরাখবর নিত রব্বানি সাহেবের কাছে। রব্বানি সাহেব যা জানেন, তা জানাতেন, কিছু আগাম অনুমানও জানাতেন। লোকে খবর জেনে ফিরে যাওয়ার সময় চালের রুটি, গাছের ফল, বাড়িতে বানানো কেক দিয়ে যেত। গোলাম রব্বানির বাড়ির গেটে একটা হাতে লেখা পোস্টারে লেখা হয়েছিল: নিরুদ্দেশের সন্ধান। গ্রামের লোকে জানত যে আত্মীয় হারিয়ে গেছে সে জীবিত আছে কিনা খোঁজ দিতে পারবেন রব্বানি সাহেব। যে লোক শহরে কাজে যায়, যে ছেলে মেষ চরায়, তাদেরই কেউ কেউ হারিয়ে যেত কখনওসখনও। উত্তেজনা তৈরি হতো নতুন করে কেউ হারিয়ে গেছে এমনটা জানা গেলে। গোলাম রব্বানির বাড়ির সামনে হারানো লোকের জ্ঞাতিগুষ্টি, বন্ধুবান্ধব ভিড় জমাত। দূর থেকে প্রজাপতির ঝাঁকের মতোই দেখাত। প্রথম চার পাঁচ দিন উত্তাপ থাকত। তারপর ক্রমে থিতিয়ে যেত আবেগ। শুধু যাতায়াত ধরে রাখত হারানো লোকের মা।
হারিয়ে যাওয়াই মানুষের ভবিতব্য। খুব কম মানুষই ভেসে থাকে। জ্বলে ওঠে আরও কম। তবু, মানুষ ভাবে সে কিছুতেই হারিয়ে যাবে না। এমনকী যে হারিয়ে গেছে, সেও ভেবে নেয় সে আছে কোলাহলের মাঝে। এই গ্রামে যারা কিছুতেই হারিয়ে যেতে চায়নি তারা নিয়মিত অস্ত্রশিক্ষা করত। বাড়ির টুকিটাকি জিনিস রেখে ৫০ মিটার দূরত্ব থেকে তাক করা অভ্যেস করত। তাদের বন্দুক আর বুলেট এনে দিত শহরে কাজ করতে যাওয়া লোকেরাই। কেউ কেউ খুব তাড়াতাড়ি পারদর্শী হয়ে উঠত। অবশ্য তার পরেও যে সে হারিয়ে যাবে না এ কথা জোর দিয়ে বলার উপায় ছিল না। সবচেয়ে আক্ষেপের কথা, যে হারিয়ে গিয়েছে তার হদিশ দেওয়ার কথা ছিল যার, যে থাকলে হারানো ছেলে বেঁচে আছে কিনা জানার সম্ভাবনাটুকু ছিল, সেই গোলাম রব্বানিই আর রইলেন না। একদিন সকালে গ্রামের লোকে তাকে আবিষ্কার করল বাড়ির উঠোনে, গুলিতে ঝাঁঝরা, নগ্ন দেহ। অর্থাৎ মারার আগে লজ্জা দিতেই তাকে নগ্ন করা হয়েছিল। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল চশমা। যাতে হত্যাকারীদের মুখ তিনি স্পষ্ট না দেখতে পারেন।
মানুষ জন্মায় বিবস্ত্র, মৃত্যুর পরে তার আর কাপড়ের প্রয়োজন থাকে না, তবু মৃতদেহ বিবস্ত্র পড়ে থাকতে দেখলে লোকে চমকে ওঠে। মৃতের গায়ে পোশাক থাকলে মৃত্যু অপেক্ষাকৃত সহনীয় ঠেকে। গোলাম রব্বানির মৃত্যু গ্রামের কেউ মেনে নিতে পারেনি। গোটা গ্রাম থম মেরে থাকে অনেকক্ষণ। বিকেলে তার দেহ নিয়ে মিছিল হয়। বর্ষণমুখর সন্ধেয় অশ্রুসিক্ত চোখে লোকে গোলাম রব্বানিকে শেষবিদায় জানায়, ছোটরা বাগানের ফুল ছিঁড়ে এনে কবরের উপর রাখে। দেখতে দেখতে ফুলের পাহাড় হয়ে যায়। গোলাম রব্বানিকে কারা মারল? গ্রামের লোক বুঝতে পারছিল, ছেলেরা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে, আর দেরি নয়, এবার প্রত্যাঘ্যাত, এবার খতম লাইন। কিন্তু গোলাম রব্বানি যেহেতু মারা গিয়েছেন, তাদের একথা বলার কেউ রইল না যে তাদের জন্যে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। আশঙ্কা করতে পারলে পালাতে পারত। প্রজাপতিদের মতো অন্যত্র চলে যেতে পারত দল বেঁধে। একরাতে ওদের প্রাণ গেল বেঘোরে। গোটা গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। যখন আকাশ থেকে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো বোম পড়ছে, গোটা গ্রাম সাদা হয়ে যাচ্ছে, তখন ওদের বুঝিয়ে দেওয়ার মত কেউ ছিল না যে এর নাম ফসফরাস বোমা। মৃত্যুর আগে গ্রামের সবাই রসুনের গন্ধ পেয়েছিল। কেউ কেউ ভেবেছিল পালিয়ে পার পাবে। গ্রামের সীমানায় গিয়ে তারা দেখে গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে জলপাই পোশাক পরা সেনা। হয় বোমার আঘাতে মরতে হবে না হলে সশস্ত্র বাহিনীর হাতে গুলি খেতে হবে। বিচলিত অবস্থায় আবার বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করলে পথেই প্রাণ যায় অনেকের। বাদ যায় না গোলাম রব্বানির বাড়িটাও।
এ ভাবে মৃত্যুদূত এসে হাজির না হলে এ সময় হয়তো এই গ্রামের লোকেরা রাতের খাবার খেত। উঠোনে হাতে তৈরি করা উনুনে রুটি সেঁকা হতো। বাড়ির পুরুষরা নিজেদের মধ্যে গম্ভীর আলোচনা করতেন, ছেলেমেয়েরা কাঠকুটো জ্বালিয়ে তাকে ঘিরে নাচ গান করত। কিন্তু জীবনকে কোনো সুযোগ না দিয়ে আকাশ থেকে নেমে এল ফসফরাস বোমা আর যাতে কেউ পালাতে না পারে তাই গ্রামটাকে ঘিরে রাখল সেনা কেননা সেটাই তাদের কাজ। পরের কয়েকদিন গ্রামে মাছির দাপট বাড়ল। অনেক দূর থেকে কান পাতলেও মাছির ভনভন শোনা যাচ্ছিল, ছ’টা বিরাট বুলডোজার এ গ্রামের মানুষের হাড়ভাঙা খাটনির পয়সায় তৈরি করা বাড়ি ভাঙছিল। আর দেখা যাচ্ছিল স্ট্রেচারে করে মৃতদেহ সরানো হচ্ছে। সেসব মৃতদেহর শরীর ছিন্নভিন্ন। কারও হাত নেই, কারওও চোখে বুলেট বিঁধেছে, কারও শুধু নিম্নভাগটুকুই পাওয়া গেছে। কোনটা কার দেহ, কে কার ভাই, কে কার কন্যা জানার উপায় রইল না। গোলাম রব্বানির মৃতদেহ ফুল পেয়েছিল, গ্রামের বাকিদের দাফন করা হল দু’আড়াই ঘণ্টায়, তীব্র অযত্নে। বোঝা গেল, পরিজন জীবিত না থাকলে লাশের কোনো দাম নেই, কোনো নামও নেই। লাশদাফন সেরে মরা বিকেলের আলোয় ওই উষ্ণপ্রস্রবণে স্নান করল সেনাবাহিনীর লোক। তারপর তারা ফিরে গেল। এবার তাদের নতুন দায়িত্ব দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের পরবর্তী কর্তব্য স্থির করবেন। ইতোমধ্যে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাদের পদক দেওয়া হল। নৈশভোজের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেনাপ্রধানরা বিদায় নিলে প্রধানমন্ত্রী ভাবতে বসলেন ফাঁকা গ্রামটায় এবার কী হবে?
দিন কয়েক পর গোলটেবিল বৈঠকে সকলের সামনে এই প্রশ্ন রাখলেন প্রধানমন্ত্রী। নানা মুনির নানা মত উঠে আসতে লাগল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, দাগি অপরাধীদের জন্য এই গ্রামে জেলখানা হোক। বনমন্ত্রী চিড়িয়াখানার প্রস্তাব দিলেন। যোগাযোগ খাটিয়ে হায়েনা থেকে ম্যাকাও সবটাই তিনি যোগাড় করে ফেলবেন এমন কথাও দিয়ে ফেললেন। সেনাপ্রধান চাইলেন বায়ুসেনার ঘাঁটি। তবে প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বেশি পছন্দ হলো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরামর্শ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী চাইছিলেন, ওখানে একটা পাগলখানা হোক।
সাতচল্লিশ দিনের শূন্যতা কাটিয়ে অবশেষে গ্রাম থেকে শব্দ আসা শুরু হলো। চোখের নিমেষে সাফ হল ধ্বংসস্তূপ, গড়ে উঠল মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পাগলদের এই গ্রামে পাঠানো হলো। তারা এখানে যত্নেই থাকত। মেল ফিমেল ওয়ার্ড আলাদা, তবু ঝামেলা এড়াতে ওদের খাবারে প্রতিদিন ওষুধ গুঁড়ো করে দেওয়া হতো। যাতে কোনোভাবেই দেহ-মনে কামভাব সঞ্চারিত না হয়। দিনের শুরুতে ডিম পেত ওরা, দুপুরে পেটভরা খাবার। সুপার সপ্তাহে একদিন আসতেন পরিদর্শনে। সেদিন সকালে ঝকঝকে তকতকে কাপড়জামা দেওয়া হতো ওদের। সুপার সপ্তাহে একদিন প্রত্যেককে কিছুক্ষণ সময় দিতেন। ওদের নোট লিখতে বলতেন, বলতেন পুরনো স্মৃতি মনে এলে লিখে রাখার কথা।
পাগলখানার চারদিকে চোদ্দ ফুটের পাঁচিল। ভেতরে বাইরে কড়া পাহারা। কিন্তু সম্ভবত জায়গাটার জলহাওয়ায় কোনো দোষ ছিল। দেখা গেল পাগলখানার লোকও এই গ্রামের লোকের মতো হারিয়ে যাচ্ছে। খবর গেল সেনাবাহিনীতে। তড়িঘড়ি গ্রামের সীমান্ত সিল করে দেওয়া হল, একটা পাগলও যাতে বাইরে বেরোতে না পারে। এসবের অবশ্য কোনো দরকার ছিল না। কারণ পাগলরা সীমানা পেরোতে চায়নি। সারাদিন বাঁজা গ্রামটায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে দিনেশেষে ওরা আবার পাগলখানাতেই ফিরে আসত, কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে আসতে হতো। দেখা যেত, কারও হাতে শিশুর খেলনা, কেউ নিয়ে এসেছে চুলের ক্লিপ, শার্ট, কেউ আবার হাড়গোড়, দাঁতের টুকরো। দেখতে দেখতে পাগলখানা হয়ে দাঁড়াল মৃতমানুষের মিউজিয়াম। দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে, সংক্রমণের ভয়ে কর্তৃপক্ষ খবর দিল স্বাস্থ্যমন্ত্রকে। স্বাস্থ্যমন্ত্রক গুরুত্ব না দেওয়ায় ক্রুদ্ধ পাহারাদাররা পাগলখানার দরজা খুলে দিল। যে যখন খুশি ঢুকছে বেরোচ্ছে। বেরোচ্ছে খালি হাতে, ঘুরছে জনশূন্য গ্রামের পথে প্রান্তরে, কবরে কবরে, ফেরার পথে নিয়ে ফিরছে ফিমার বোন, পেলভিক বোন, জলের বোতল, বাচ্চাদের স্কুলের ইউনিফর্ম, গাঢ় লাল লিপস্টিক। প্রধানমন্ত্রীর টনক নড়ল যখন আবার সেই জনশূন্য গ্রামে একজন সাংবাদিক পৌঁছল। পাগলখানা বন্ধ করার তোরজোড় শুরু হলো। সমস্ত পাগলকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হলো তারা যেন মুখ না খোলে। পুড়িয়ে দেওয়া হলো তাদের নোটখাতা, যেখানে তারা দিনানুদিনের বর্ণনা লিখে রাখত। ওদের ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত শুরু হলো। ফের খালি হয়ে গেল গ্রাম। এবার আর মাছিও এল না। অজস্র মৃতের স্মারক বুকে দাঁড়িয়ে রইল একা পাগলখানা।
মৃত্যুর আগে গোলাম রব্বানির জামাপ্যান্ট খুলে নেওয়া হয়েছিল। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল চশমা। কারা তাঁকে মারল তিনি জানতে পারেননি। এই পাগলফেরা দিনে তিনি থাকলে দেখতেন, এক পাগল তার চশমা চোখে দিয়ে চলে যাচ্ছে অনেক অনেক দূর, ফিরে যাচ্ছে যেখান থেকে সে এসেছিল ঠিক সেইখানে। অনেকের সঙ্গে গ্রাম ছাড়ছে আরেক বয়স্ক পাগলদম্পতি, গোলাম রব্বানির জামাকাপড় তাদের গায়ে। গ্রামের সীমানা বরাবর, তারা কাঁটাগাছ লাগিয়েছে। আকাশ থেকে ফসফরাস ঝরে পড়লেও ক্যাকটাস মরবে না। বহু বছর পর গাছে ফুল হবে। ফুলের নাম ক্যাকটি।