Writing Non-Fiction

প্যালেস্টাইন: সিনেমা জীবনের মতো, জীবন সিনেমার মতো

প্যালেস্টাইন: সিনেমা জীবনের মতো, জীবন সিনেমার মতো

রূপকথারা মৃত। কারণ প্রত্যেক ফিলিস্তানির জীবনের পল অনুপলে নতুন গল্প জন্ম নেয়। যে গল্প মহাকাব্যের থেকেও বেদনাবিধুর, ভোঁতা অস্ত্রের সশব্দ আঘাতের মতো- জোরালো, ডুবজলের মতো শ্বাসরোধী। প্রত্যেক ফিলিস্তানির নিজস্ব, স্বতন্ত্র গল্প রয়েছে। মনে রাখতে হবে, এই গল্পগুলি হঠাৎ এক সকালে জন্মায়নি, দশকের পর দশক বাতাসে ভাসছে অশরীরীর অভিশাপ হয়ে। দু’চারটে এমন গল্পই বলি আজ।

ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বুরিন গ্রামের বাসিন্দা ইউসেফ আলি কাদোস একজন সাধারণ প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক। আজ থেকে বারো বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে কাদোস বলেন,  ‘গাছ আমার মা। আমার বয়স এখন সাতাত্তর। ১৯৫২ সালে, স্কুলে পড়ার বয়সে আমি অনেকগুলি জলপাই গাছ লাগিয়েছিলাম। স্কুল থেকে ফেরার পথে বাড়ি না ঢুকে আগে জলপাই বাগানটায় ঢুঁ মারতাম। পনেরো বছর লেগেছে গাছগুলির ফল দিতে। প্রতি বছর আমরা এই গাছগুলি থেকে চল্লিশ জেরিক্যান তেল পেতাম, ওই টাকায় শখ আহ্লাদ মেটাতাম। চোখের সামনে তিন তিনবার দেখেছি আমার সাধের গাছগুলি পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। সেই জায়গায় অন্যদের থাকার বন্দোবস্ত হচ্ছে গায়ের জোরে। একজন কৃষকের জন্যে জমি হারানোর চেয়ে দুঃখের কিছু কি আছে?  কিন্তু কিছু বলতে পারিনি।  কারণ আমরা যদি একজন ইহুদি বসতিস্থাপনকারীর গায়ে হাত দিই, আমাদের উপর অত্যাচার হবে। যদি উল্টোটা হয়, কখনও কিন্তু একজন ইহুদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। চুপ করে দেখতে দেখতে মরে যাওয়াই আমাদের কাজ।’  

২০০৯ সালে ইজরায়েলি সেনার বোমাবাজির আগে পর্যন্ত মানাল সুবেইর-এর পরিচিতি ছিল, তিনি এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী। সুখী গৃহস্থ বলতে যা বোঝায়, তাই। বাড়িতে বিরাট বিরাট ঘর, প্রশস্ত জানালা, আলোহাওয়ার বাড়বাড়ন্ত। সে বাড়িতেই একদিন লিফলেট রেখে গেল ইজরায়েলি সেনা। জানিয়ে দিল, বাড়ি ছাড়তে হবে। পরিবারের তিনজনের প্রাণটুকু ছাড়া আর কিছু নিয়ে বেরোতে পারেননি মানাল। জায়গা হলো গাজার অনতিদূরে একটা ক্যাম্পে। যেখানে জল, শৌচাগারের সুব্যবস্থা নেই। প্রথম রাতে কম্বল জোটেনি, তীব্র শীতে শুতে হয়েছিল চার্টপেপার গায়ে জড়িয়ে। এরপর যেতে হলো অন্য একটা ক্যাম্পে, সেখানে আবার মশামাছির উপদ্রব। যখন পরিস্থিতি একটু শান্ত, মানাল স্বামী সন্তান-সহ রওনা হলেন বাড়ির দিকে। গন্তব্যে পৌঁছে দেখলেন সাধের বাড়িটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন বোনের বাড়িতে মাথা গোঁজা, তারপর আবার ঠাঁই ক্যাম্পে। ওঁর সন্তান ক্যাম্প থেকেই স্কুলে যেত। কিন্তু রোজ রাতে বিছানা ভেজাত সে, ঘনঘন কেঁপে উঠত ঘুমের মধ্যে। অবসাদের অন্ধকার থেকে কখনও বেরোতে পারেনি ছেলেটা।

মহম্মদ কাবেনের বয়স ৪৩। এখন বাধ্য হয়ে থাকেন জেরুজালেমে। তার নিজের ভিটে ধ্বংস করা হয়েছে তিনবার। প্রতিবার তিনি ফিরে গিয়েছেন, নতুন করে ঘরদোর তৈরি করেছেন। বাহিনীর নির্দেশে রাতারাতি সেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছে। ফিরে দেখেছেন কিচ্ছু নেই, চারদিকে্ স্রেফ ধুলোর পাহাড়। কেঁদেছেন, কেউ শোনেনি সেই কান্না, কারণ তার প্রতিবেশিরাও ঘর হারিয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদছিলেন সে সময়ে। কাবেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ওরা পাহারা দেয় যাতে আমরা আমাদের বাড়িতেই ফিরতে না পারি। একরাতে আমরা ৬৬ জন এলাকা ছেড়েছি। ফিরে দেখেছি, ৩৬ টা বাড়ি ওরা ধ্বংস করে দিয়েছে। মন ভেঙে গেছে। বেঁচে আছি কোনো রকমে।

অমল আস সামৌনি । গাজার মেয়ে। বেঁচে থাকলে এখন বয়স হওয়ার কথা ২২। ২০০৯ সালে ইজরায়েল সেনা এক দিনে তার চোখের সামনে তাঁর বৃহত্তর পরিবারের ২৭ জনকে মেরে ফেলে। তার মধ্যে ১১ জন শিশু ছিল। ৩৫ জন জখম হয়। তার মধ্যে অমলও ছিল।  মাথায় বুলেটের গভীর ক্ষত নিয়ে তাকে বাঁচতে হয়েছে। তিন বছর প্রতিদিন  নাক থেকে রক্ত বেরতো। বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যুদৃশ্য কখনও সে ভুলতে পারেনি।   

ইউসেফ, মানাল, কাবেন, অমলরা পালিয়ে বাঁচে, চুপ করে বাঁচে। চোরের মতো বাঁচে। দেশ ছাড়ে রাতের আঁধারে। মরে বাঁচে। বাঁচে কিন্তু বাঁচে না। রেগে যায়, গুমরে কাঁদে। ক্যালেন্ডারে দাগ দেয়, সুদিনের দিকে চাতকের মতো চেয়ে থাকে। কিন্তু ওদেরই বাড়ির কেউ ভাত ফেলে উঠে যায়। বলে, শালা শেষ দেখে নেব। তেমনই এক মেয়ে আহেদ তামিমি। দীর্ঘদিন মা, ভাই, বাপের উপর ইজরায়েল সেনার মস্তানি দেখে একদিন দাদার দিকে  আঙুল তোলে। হোক না বয়স ষোলো। গলার শিরা ফুলিয়ে বলে, ‘এই শালা! কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমার ভাইকে!’ তার গলা হৃদয়হীন সেনানায়কের অন্তরাত্মাও কাঁপিয়ে দেয়। ক্ষণিকের জন্য সে থমকে দাঁড়ায়। কিশোরী চেঁচাতে থাকে, ‘ব্যাঙ্গ করছ, আমরা সবাই একদিন তোমাদের নিয়ে বিদ্রুপ করব। যেদিন আমার দেশ স্বাধীন হবে।’ বলে, ‘কত জলপাই গাছ উপড়ে ফেলবে! আমরা রোজ একটা করে জলপাইগাছ লাগাব।’ ভাইয়ের কপাল, চোখ তাক করে রবার বুলেট ছোড়ে সেনামাস্তান।  রাগে অন্ধ  মেয়ে চড় কষায় মাস্তানের গালে। ঠাঁই হয়, জেলকুঠুরিতে। 

এগারোজনের ছ’টা বিছানা। হৃদয়হীন অফিসার বলে, ‘তুমি ভেবেছ একজন অফিসারকে চড় মেরে প্যালেস্টাইন স্বাধীন করবে?’ বাচ্চা মেয়েটি বলে, ‘আমার শরীরটাই স্রেফ জেলে আছে। মন স্বাধীন। প্রতিটা ফিলিস্তানির হাতে হ্যান্ডকাপ, মন স্বাধীন।’

ওমর বলে একটা ছেলের কথা বলে শেষ করি। রোজ রোজ সেনার অত্যাচার সহ্য করে ক্রুদ্ধ ওমর একদিন বদলার নেশায় মেতে ওঠে। ওমর, তারেক, আমজাদ, তিন বন্ধু মিলে এক সেনাকর্মীকে খুন করে। ধরা পড়ার পর সেনা অফিসার সেলে তার অন্ডকোষ লাইটারের আগুনে ঝলসে দেয়। বন্ধু তারেককে ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি লিখিয়ে নিয়ে তাকে ছেড়েও দেয়। ওমর আমজাদের সঙ্গে সংঘাতে তারেকের মৃত্যু হয়। ওমর-আমজাদের বিচ্ছেদ হয় কারণ সে জানতে পারে তারেকের বোন, মানে তার প্রেমিকাকে অন্তঃসত্ত্বা করেছে আমজাদ। ভাঙা মন নিয়ে একা বাঁচতে থাকে ওমর। বহু বছর পর সে জানতে পারে মিথ্যে রটিয়েছিল সেই অফিসার। ওমর তখন অবশ্য সেই অফিসারের বিশ্বস্ত চর। একদিন অফিসারের থেকে বন্দুক চেয়ে সে অফিসারকেই গুলি করে। 

ওমর একটি সিনেমা। বাকি গল্পগুলি অবশ্য জীবনের। প্যালেস্তাইনে জীবন সিনেমার মতো। সিনেমা জীবনের মতো।

Arka Deb

About Author

You may also like

article
Interview Writing

Hands-On With Borderlands 3 And 2 New Vault Hunters

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected
article
Interview Writing

Tesla’s Cooking Up A New Way To Wire Its Cars, Report Says

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.