Writing Non-Fiction

সংবাদ মূলত ক্লিক?

সংবাদ মূলত ক্লিক?

প্রোমোটার সিন্ডিকেট থেকে সস্তার মাল কিনেছে। তারপর যা হোক করে ফ্ল্যাটবাড়ি তুলে দিয়েছে। সেই ফ্ল্যাটের বত্রিশটি পরিবারের একটি আমার। মাঝে মাঝেই বাথরুমের পাইপ ফুটো হয়ে যায়। পাথর খুলে বেরিয়ে আসে। জল জমে থাকে। দৈন্যদশাটা কিছুতেই ঢাকা যায় না। বছর ভর লড়তে হয়। বাংলা ভাষাটার অবস্থাও ঠিক এমন। অন্তত কাগুজে বাংলা ভাষার।  আরও বিশেষ ভাবে বললে, অনলাইন বাস্তুতন্ত্রে পেশাদারদের ব্যবহৃত ভাষার। সংবাদ, ফিচার- যে আঙ্গিকই ধরে নিই না কেন, লাবণ্য ও গঠনের প্রশ্নে ভাষার পাইপ ফুটো। মাতৃভাষা-মাতৃদুগ্ধ, এসব আবেগ বায়বীয়, নিরালম্ব। বড়জোর একদিনের টিআরপি, পেজভিউ-র (ডিজিটাল মিডিয়ায় পাঠক গণনার সূচক) সুবন্দোবস্ত মাত্র।

অভিজ্ঞতার সুবাদে বলি, আমরা যে লেখাগুলি পাই তাতে সীমাহীন বানান বিপর্যয় চোখে পড়ে। এমনকী বিষয়টা এতটা মাত্রাছাড়া হয়ে যায়, মাঝে মাঝে ডেস্ক বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাদের বক্তব্য ময়লা সাফাই করতে এসেছি বলে কি যা খুশি তাই আসবে? যারা লিখছেন তাদের কী আর কি গুলিয়ে যায়। ণ-ত্ব, ষ-ত্ব বোধ থাকে না অধিকাংশের। বাক্যগঠনে চূড়ান্ত আড়ষ্টতা, অবহেলা থাকে। স্পষ্টই বোঝা যায়, যিনি লিখছেন তিনি চারটি লিঙ্ক জোগাড় করে কাজসারা কেঠো অনুবাদ করেছেন। স্পষ্টই দেখতে পাই, যতটা সময় লেগেছে লিখতে, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় চলে যায় লেখাটি পরিষ্কার করে পাঠযোগ্য করে তুলতে। কিন্তু দেখেছি  একজন নবীন প্রতিবেদক বা লেখককে তাঁর লেখার খসড়া এবং প্রকাশিত কপির ফারাকটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোও হয়, তিনি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেন না। তাঁর লেখায় অযত্ন আর ভুলগুলি থেকেই যায়। আমরা সম্পাদনা করতে থাকি কারণ সেটাই আমাদের কাজ। আমরা ছোট, প্রতিদিন হাজার কপি প্রকাশ আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কম কিন্তু নিখুঁত সুসম্পাদিত প্রতিবেদন প্রকাশে আগ্রহী, সেটাই আমাদের মডেল। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, বেশির ভাগ ডিজিটাল মাধ্যমের মডেলটা ঠিক উল্টো। সম্পাদনা বিভাগটিই নেই। সকলেই লেখেন, অনর্গল লেখেন। অযত্নে ভরা অসংলগ্ন কপি লেখেন। অসম্পাদিত সেই প্রতিবেদনই সকলে পড়েন। দোষারোপে, নিন্দামন্দে অসুখ সারে না। কাজেই কোনো একজন ব্যক্তি, কোনো একটি প্রজন্ম, দু’চারটি প্রতিষ্ঠানকে দাগিয়ে না দিয়ে যদি উপসর্গটার কার্যকারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি, যদি খুঁজি ডিজিটাল জমানায় ২৩ কোটি মানুষের মুখের ভাষার এই দৈন্যদশা কেন হলো, কী দেখব? 

দেখব, যারা লেখার কাজে এসেছেন, তাদের সিংহভাগ লিখতে ভালবাসেন না। পড়তেও ভালবাসেন না। লেখেন কাজটা পেয়েছেন, কাজে থাকতে চাইছেন বলেই। ঠিক যেমন আমার ফ্ল্যাট তৈরির বরাত এমন কেউ পেয়েছিল যার হৃদয়ে নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটির প্রতি কোনো বাড়তি দরদ ছিল না। সাধারণ মানুষ বানানবিধি কার্যকারণ -সহ জানবেন না সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লেখাজীবী জানবেন, প্রত্যাশিত। পুরনো অনেকেই কিন্তু এই বানানবিধি খুঁটিনাটি জানেন না। কিন্তু না জানাটা ম্যানেজ হয়ে যায় রোজের পড়ায়। কাজের ভাষার  শব্দের সঙ্গে অকাজের সহবাসে, শতসহস্র রাত্রি যাপনের আহ্লাদে, ক্রমাগত সংলাপে বানান বাক্য-বিন্যাসের একটা বোধ গড়ে ওঠে। ভুল-ঠিক ধরে চোখ, কান। তারপরেও ভুল হয়, কিন্তু তা নগন্য। সেক্ষেত্রে হাতের কাছে রাখা অভিধান সহায়। সম্পাদনা বিভাগের বাড়তি তৎপরতায় ওটুকু এড়ানোই যায়।

কিন্তু মিলিনিয়ামে খেলার সেকেলে নিয়মগুলি বর্জিত হয়েছে দ্রুত। বই-কাগজ কিছুই না পড়া সুপ্রতিষ্ঠিত অভ্যেস। দু’টি প্রজন্ম এতে ধাতস্থ হয়ে গিয়েছ। বাংলায় লেখা হচ্ছে হরবখত অথচ ডেস্কে অভিধান নেই, এটাই আজকের ছবি। যারা লিখছেন তারা দিনের বেশির ভাগ সময় নিজস্ব চৌহদ্দিতে মেসেজে কথা বলেন, ফোনেটিক্সের ভাষায়, মুরাদ টাকলায়, অতি সংক্ষেপে। যেমন: ki khbr, khn aschs, khte jbi (কী খবর, কখন আসছিস, খেতে যাবি)। অর্থাৎ বানান বাক্যবিন্যাস সম্পর্কে তাদের আলাদা কোনো সুবিবেচনা নেই বললেই চলে। কোথাও কোনো মায়া নেই। এই ধরনের অভ্যেস-বিশ্ব থেকে যারা ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমে আসছেন, তাদের প্রথমেই শব্দমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়। ধরা যাক, দিনে তিনশো শব্দের দশটি প্রতিবেদন লিখতে হবে। অর্থাৎ মরো বাঁচো তিনহাজার শব্দ লিখতেই হবে।  লেখাজীবীটি অবশ্য লিখেই খালাস হতে পারেন না। তারপরেও দায়িত্ব আছে। লেখাটিকে চালাতে হবে। অর্থাৎ বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেই হবে। লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে আগে থেকে। বীরপুঙ্গব একে একে বাণ ছাড়ে। যৌনতা, সুড়সুড়ি, জ্যোতিষ, বিতর্ক। যাঁর লেখায় যত বেশি দূষণ সম্ভাবনা, তাঁর লেখার তত কাটতি। দেখা যায়, যে কারণে একটি লেখা পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে, অর্থাৎ বিষয়ের গভীরতা, লেখার গুণমান, বানান, যতিচিহ্নের যথাযথ প্রয়োগ, বাক্যের অর্থবহ বিন্যাস, চাকরি বাঁচানোর সূচকগুলিতে এগুলি কোথাও নেই। ভাষাটা যে জানতে হবে, প্রতিনিয়ত শিখতে হবে, বড়দের গুণগুলি আত্মস্থ করতে হবে, একটি লেখা সাজানোর নানবিধ কৌশল রপ্ত করতে হবে, এই বোধটা তৈরিই হয় না। দিনশেষে পড়ে থাকে প্রশ্নবোধক আর বিস্ময়সূচক চিহ্নে ঠাসা, হিন্দিঘেঁষা, কেঠো, প্রাণহীন বাতকর্ম। এই প্রক্রিয়াটা যখন চলে, একজন রিংমাস্টার ছড়ি হাতে ঘোরেন, তিনি ম্যানেজার। নম্বরবাবু। তিনি ভাষাটায় দু’টি বাক্য নির্ভুল লিখতে পারবেন না। কিন্তু তিনি একজন আদর্শ ইয়েসবস। যে করেই হোক, কলুর বলদকে ঘানি টানিয়ে লেখার সংখ্যা আর পাঠকসংখ্যা স্থিরনিশ্চিত করাই তাঁর কাজ।

এর সঙ্গে এসে জুড়েছে কারিগরি অসহায়তা। অনেকেই লেখার জায়গায় স্পিচ-টু-টেক্সট অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করেন। সময় বাঁচাতে পদ্ধতি হিসেবে এই তুক খারাপ নয়। বিশেষত রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। স্পিচ টু টেক্সটে বড় অর্থনীতির ভাষা ইংরেজি যেমন প্রায় নির্ভুল ভাবে প্রয়োগ করা যায়, বাংলায় তা এখনও সম্ভব নয়। বানান বিপর্যয় ঘটে প্রতিটি লাইনে। এখন, যিনি লিখছেন তাঁর যেহেতু ঠিক ভুল জ্ঞানটাই তুলনামূলক ভাবে আগের দশকগুলির তুলনায় কম, যেহেতু তাড়া আছে, তাই দ্রুততার আনন্দে অসম্পাদিত বিপর্যস্ত পাঠটিই তুলে ধরেন। এর চেয়েও বড় সমস্যা তৈরি করে গুগল ট্রান্সলেটর। গুগল ট্রান্সলেটর কতটা নিখুঁত তথ্য পরিবেশন করবে তা নির্ভর করে, টার্গেট ভাষার কত তথ্য গুগলের ভাণ্ডারে রয়েছে তার উপরে। বিশ্বের ওয়েবসাইটের ৬০ শতাংশই ইংরেজিতে। তারপরেই রমরমা স্প্যানিশ ওয়েবসাইটের। বাংলায় ওয়েবসাইটের পরিমাণ সেখানে ১.৫ শতাংশ। তথ্যের অপর্যাপ্ততার কারণে গুগল কাঁচা অনুবাদ করে। সে আমাদের অহংকার অলংকারচিহ্নগুলি বুঝেই উঠতে পারে না। মূষিকপ্রসবই তার নিয়তি। আর দ্রুত কাজ সারার নেশায়, কথা রাখার তাড়নায়, সেই ভাঙাচোরা লেখাই যথাযথ সম্পাদনা ছাড়া, কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে অনেকে উৎপাদন করেন। বাংলা ডিডিটাল পৃথিবীটা ভরে গিয়েছে এই আবর্জনায়। বিপদের কথা এই যে, গুগল আবার তথ্য সংগ্রহ করছে এই অসম্পাদিত লেখা থেকেই। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যে সে আরও ভালো কাজ করবে সেই সম্ভাবনাও কম। দেখা যাচ্ছে, গুগল এবং বাঙালি প্রতিবেদক একই সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে। হাতের কাছে ভালো নমুনা নেই, কাজেই লাগসই যান্ত্রিক লেখা উৎপাদনই একমাত্র অভীষ্ট। 

বাংলা ভাষার গ্রন্থি ছাড়িয়ে সহজ সংযোগের একটি মান্যভাষা তৈরি করেছিল সংবাদমাধ্যম। সময় লেগেছে ২০০ বছরেরও বেশি। ভাষার সংযোগক্ষমতা তৈরি করেছে বাজার। বাজারের মাপ এনেছে বিজ্ঞাপন অর্থাৎ খরচ তুলে কাজ চালিয়ে যাওয়ার একটি উপায়। আজ এই মডেলটিই অচলমুদ্রা। গুগল একটি ডিজিটাল মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রযুক্ত করার জন্যে মাধ্যমটির গুণমান দেখবে না। দেখবে না কোনো বহুজাতিকও। দেখা হবে মাধ্যমটি কতজন ক্লিক করে। যে বিজ্ঞাপনটি আসবে তার ভাষা হবে ইংরেজি। অকস্মাৎ বাংলা হলে, নিশ্চিত ভাবে তা হবে ভুলে ভরা, অসার অনুবাদ। বাজার নেই, ফলে বাংলায় কাজ করবে এমন ভালো বিজ্ঞাপন সংস্থাও হাতে গোনা। কাজেই খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের ভাষাও ক্রমেই অশ্লীল, অকহতব্য হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে।

কেউ বলতেই পারে, সমস্যাটা তো বুঝলাম সমাধান কি আছে? লোকাল ট্রেনের ভেন্ডারে, সবজি বাজারে, রেলকলোনিতে, মানুষের খিস্তিতে, রাগে ক্রোধে ভাষা বেঁচে থাকবেই। কিন্তু কচ্ছপের মতো স্থবির হবে সেই বাঁচা। ভাষার কালোজলের দিঘিটায় নিয়ত ঢেউ খেলতে পারে স্রেফ একটিই আয়ুধে। তা হলো- নাছোড় ভালোবাসা। ভালোবাসা থেকেই আসবে যত্ন, জানার চেনার তাগিদ, রক্ষা করার নাছোড় তাগিদ।

যে তাগিদ একদিন সালাম-বরকতদের ছিল।

Arka Deb

About Author

You may also like

article
Interview Writing

Hands-On With Borderlands 3 And 2 New Vault Hunters

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected
article
Interview Writing

Tesla’s Cooking Up A New Way To Wire Its Cars, Report Says

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.