নিকষ অন্ধকার। প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। না পালালে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেবে ওদের। কতদূর যাবে ওরা! পথেই প্রাণ যাবে না তো? বাচ্চাটার পুতুলগুলি পড়ে রইল। পড়ে রইল বিয়েতে পাওয়া সাধের বাসন। আলমারি ভরা কাপড়জামা, সাধ করে কেনা জুতোজোড়া। যে বা যারা পালাচ্ছে আজ, তারা কি আর ফিরতে পারবে? এমন মর্মান্তিক দৃশ্যমালা আর ঘটনাপঞ্জির সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিচয় বলিউডের সূত্রে হয়নি। পরিবারটা ভেঙে টুকরোটুকরো হয়ে গেল, কী দোষ ছিল ওদের? এই প্রশ্ন কোনো রুদ্ধশ্বাস গল্প পড়ে আমার মনে জাগেনি। আমার মনে প্রশ্নেরা দল বেঁধে এসে বসেছে প্রথম কৈশোরে। গুজরাত দাঙ্গার সৌজন্যে। খবরের কাগজে ভিটেহারা মানুষের দিনলিপি পড়ে।
এ ভাবেই কাগুজে অক্ষরে পরিচয় বিলকিসেরর সঙ্গে। বিলকিস বানো এক ধর্ষিতার নাম। গোধরা কাণ্ডের পর গুজরাটে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়াচ্ছিল হিংসার আগুন। শাসক নিশ্চুপে মদত দিচ্ছিল সেই ঘটনায়। দাহাদের বাসিন্দা বিলকিস সপরিবারে রাতের অন্ধকারে পালানোর চেষ্টা করছিল। আমেদাবাদের রন্ধিপুরের কাছে দাঙ্গাবাজরা পথ আটকায়। একে একে বিলকিসের পরিবারের চোদ্দজনকে খুন করে ওরা। বিলকিসের মেয়ে সালেহাকে খুন করা হয় পাথরে মাথা থেঁতলে। গণধর্ষণই বা বাদ থাকে কেন! একুশ বছর বয়সি এক গর্ভবতী। বাইশবার ধর্ষণ ‘প্রাপ্য’ তার। কার অন্যায়ের শাস্তি কে পায়!
বিলকিস এবার কোথায় যাবে, সন্তানহারা মা, অভিভাবকহীন মেয়ে, সঞ্চয়হীন দম্পতি, এক ধর্ষিতা আর তার স্বামী, রাষ্ট্র ওদের কোথায় জায়গা দেয়?
আমরা দেখেছি বিলকিসদের টেনেহিঁচড়ে বাঁচতে হয়। মরণ আসেনি বলে। ওদিকে ইন্টারনেট আসছে। পাড়ায় পাড়ায় সাইবার ক্যাফে। আমরা বেড়ে উঠছি। দেখছি করিনা কাপুর আর কেট উইনস্লেটকে। বিলকিসের পেটে বিদ্যে নেই। বিলকিস আধুনিকা নন, চলিয়েবলিয়ে নন। শুরু হয় যাযাবর জীবন। এই সংগঠন থেকে ওই সংগঠন ঘুরে বেড়ানো। যে নির্যাতন বিলকিসকে সইতে হলো, যে স্মরণের ভার বিলকিসকে বইতে হলো, তা লাঘব হবে কীসে! রাষ্ট্র এসব ক্ষেত্রে একটাই ওষুধ বোঝে। টাকা। বিলকিসকে পাঁচ লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয় প্রথমে। আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী মিলে মোট ১৭ জনের হত্যা, ২২ বার ধর্ষণের ক্ষতিপূরণ পাঁচ লাখ।
লেখাপড়া না-জানা বিলকিস সেদিন ‘না’ বলেন। এই না-এর সঙ্গে তাঁর যাত্রাশুরু, চলবে দীর্ঘ-পথরেখা বরাবর। একদিকে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠের কল্পলোক ‘হ্যাঁ’-এর দিকে ঢলেছে। যা কিছু অন্যায়, যা কিছু বিভেদ সৃষ্টি করে, নাগরিক সমাজে ঘৃণার আবহ তৈরি করে, সব একটু একটু করে সইয়ে নিচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হিংসার আঁচে শরীর সেঁকছে। বাবরি ভাঙা জমিতে রামমন্দিরের স্বপ্ন দেখছে। তাবরেজদের গাছে বেঁধে পেটাবে বলে তৈরি হচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় মুসলিমকে একঘরে করার অজুহাত খুঁজছে, আখলখদের ফ্রিজে গোমাংস আছে কিনা যাচাই করে দেখবে বলে জড়ো হচ্ছে। আফরাজুলদের পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করছে।
আর ইংরেজি-হিন্দি কিছুই না জানা বিলকিস? ওর স্বামী ইয়াকুব রসুল? ওই এক ‘না’ আকড়ে বেঁচে থেকেছে। বছরের পর বছর। প্রশাসন, সরকারি উকিল, পুলিশ-রাষ্ট্রশক্তির সব পেয়াদাদের ক্রমাগত ‘না’ বলে গিয়েছেন বিলকিস। এক বছর। দু’বছর। তিন বছর। সতেরো বছর। বলেছেন, মেনে নেবো না।
সতেরো বছর পর যখন সুপ্রিম কোর্ট বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলে বিলকিসকে। বিলকিস চান, এই টাকায় বড় মেয়েটা আইন পড়ুক। বিলকিস চান, স্মৃতির সঙ্গে যুঝেবুঝে বাঁচতে।
আমরা তখন পর্যন্ত ভেবেছিলাম কিছু ন্যায়বিচারের বোধ আজও অবশিষ্ট আছে। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন নিছক প্রবাদ নয়। আইনের শাসন, আছে। ফাঁসি হয়নি, কিন্তু অপরাধীদের যাবজ্জীবন তো হয়েছে! সব হিসেব বদলে দিয়ে এল আজাদি কা অমৃত-মহোৎসব। গুজরত সরকার ১১ ধর্ষকের পক্ষে সওয়াল করল। ১১জন খুনি, ধর্ষক ছা়ড়া পেয়ে গেল। ওরা বলল, হিন্দুরা এমন কাজ করে না। আমাদের জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল। কুড়ি বছরের নিকষিত হেম হিন্দুমন বলল, কথা ঠিক। একচুলও মিথ্যে নয়। ধর্ষক মুসলমান। অপরাধী মুসলমান। এখানে হিন্দুমুক্তি ঘটেছে। আগামী দিনে ক্রমে হিন্দুমুক্তি ঘটবে। বাজি ফাটাও। বাজনা বাজাও। সংবর্ধনা দাও ওদের।
এবার কী করবেন বিলকিস! আবার ধর্ষণের ভয় বুকে অপেক্ষা করবেন? পাঁচ মাস ওরা বাইরে ছিল। পাঁচ মাস রাষ্ট্র তাঁকে বুঝিয়েছে যারা ওর সন্তানের মাথা থেতলে দিয়েছিল তারা বেকসুর। দোষ আসলে বিলকিসদেরই। পাঁচ মাস পর সুপ্রিম কোর্ট বলে, এক্তিয়ার বহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুজরাত সরকার। অপরাধীরা ফের জেলে গেল। কিন্তু কিছু প্রমাণ রইল বাইরে, খোলা হাওয়ায়।
বোঝা গেল, রাষ্ট্রযন্ত্র একটি বৃহদায়তন লিঙ্গ। সময়ে সময়ে সে ধর্ষকের হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ধারালো অস্ত্র হয়ে ওঠে। বাইশ বছর আগে এক গ্রাম্য তরুণীর শরীরটাকে এগারো বার ধর্ষণ করেছিল জনাকয়েক হিন্দুবীর। আর হিন্দু-রাষ্ট্র সদাসর্বদা তার মন ধর্ষণে উদ্যত। বিলকিসের মন আরও কতবার ধর্ষিত হয়েছে গত ২২ বছরে? জানি না। ওঁর হয়ে বিচার চেয়েছে ক’জন! জানি না। বরং বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে এটাই ভারত। এখানে থাকতে হলে এভাবেই থাকতে হবে।
বিলকিসের ধর্ষকরা শ্রীঘরে গিয়েছে, ঠিক। এদিকে দাঙ্গাবাজ হিন্দুত্ববাদীদের মনপসন্দ রামমন্দিরও প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। কিন্তু যারা রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে হাথরসের নির্যাতিতার দেহ পুড়িয়ে দেয় রাতের অন্ধকারে, পরিবারের অমতে, যারা শিশুমৃত্যু আটকে দেওয়া কাফিল খানের জিনা হারাম করে দেয়, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আটকে রাখে উমর খলিদ- শারজিল ইমামদের, লোকতন্ত্রে তাদের বিচার কে করবে? গণকবরে রাজদণ্ড হাতে বিজয়উৎসব উদযাপন করছে যে রক্তকরবীর রাজা, চোখে ঠুলি বলে যাকে দেখেও দেখে না কেউ, তার বিচার কে করবে?