Non-Fiction Writing

মারাদোনা থেকে মেসি

মারাদোনা থেকে মেসি

চোখ যতই উজ্জ্বল হোক, যতই থাকুক মুসকো গোঁফ, ঠেলায় না পড়লে বেড়াল কখনও বাঘ হয় না। হঠাৎ একদিন কেউ সমুদ্রের  তলদেশ ফুঁড়ে উঠে আসে না। ঠেলাতেই পড়েছিলেন মারাদোনা। জন্ম নরকশহরে। আট ভাইবোনের সংসার। বাবা কারখানায় কাজ করেন। ইতালিয় রিফিউজি মা প্রায়শই রাতে খেতে বসে বলেন, পেটেব্যথা। ছোট ছেলেটা বুঝে নেয় পর্যাপ্ত ভাত নেই। ভাত নেই, ছাত নেই, চারপাশ জুড়ে রয়েছে নেশা আর অপরাধের নিশিডাক। এখান থেকে কোথায় যাবে এক নবীনকিশোর? রাস্তা তো দুটো। হয় অপরাধের তাল লয় ছন্দ শিখে হয়ে ওঠো গডফাদার। ঝাঁপ দাও মরণকূপে। নইলে জাল কেটে বেরিয়ে যাও। অবশ্য, যদি স্কিল থাকে। মারাদনোর কিছুই ছিল না, ওই স্কিলটুকু বাদে। শরীরের সামর্থ্যটাকে বাজিতে রেখেই  তিনি রণে চললেন। ফুল ফোটালেন দেশ দেশান্তরে। শৈশবের ভূত তাকে তাড়িয়ে মারল। শৈশব তাঁকে ছাড়ল অসময়ে, তিনি শৈশবকে ছাড়লেন না। বিপন্ন বিস্ময়ে ভ্রমের দেশে ভ্রমণ চলল।

মারাদোনা দেশের হয়ে জিতলেন, ক্লাবের হয়ে সাফল্যের সমস্ত শিখর ছুঁলেন। কিন্তু তিনি থামতে চাইলেন না। ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁর গাত্রদাহ হলো না। দৌড় থামালেন না। দূর থেকে, টিভি ডকুমেন্টারিতে তার অনর্গল বক্যিবাগিশী দেখলে যে কারো মাথায় খেলে যাবে বিদ্যুৎরেখা। মন বলে উঠবে, “সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়! অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?”  নিজেকে এতটুকু শান্তি দেননি মারাদোনা। সব পেয়ে খুশি হননি, সব ভেঙেছেন আবার। শিশু যেমন, গড়ে, ভাঙে, আবার গড়ে। আসলে যেখান থেকে এসেছেন, সেখানে কখনও ফিরে যেতে চাননি মারাদোনা। চাননি কেউ ফিরে যাক। খেলায়, নেশায়, সকল বাজিতে নিজেকেই আগে সমর্পণ করেছেন। পায়ে না হলে বাড়িয়ে দিয়েছেন হাত। কেন জিততেই হবে, ন্যায়ে অন্যায়ে, যে কোনো ডানা ভয় করে জয়ের রাস্তায় ছাড়া আর কোনো রাস্তায় হাঁটা যায় না ?কারণ ওই, যে সময়টা ছিল অপচয়ের জন্য, অকারণের জন্য রাখা, সে সময়টা মারাদোনাকে ছুটতে হয়েছে। মারাদোনা আর থামতে চাননি, ঘুমোনোর আগে ঘুমোতে পারেননি। তাকে দেখে মনে হয়েছে, “মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।” কোনো সাংবাদিক সমালোচনা করলে তাই হাসিমুখে মারাদোনা বলতেন, “এটা তোমার ভাবনা, কিন্তু আমার উঠে আসাটা, আমার দিকটা তুমি ভাবতেই পারবে না।”

এই মারাদোনাকে দেখা মানে আসলে  জীবনের চৌকো ছবিটা অন্য দূরবীনে দেখা। দেখা সরল একটেরে বাজার যাওয়া, খাওয়া-ঘুম, প্রেম যৌনতা মধ্যবিত্ততার উল্টোমেরুকে, যা মানুষের ছায়ার তুলনায় মানুষকে দীর্ঘতর করে। মারাদোনা বুঝিয়ে দেন, সাফল্যের গ্রাফটাকে আমরা যেমন সদাউল্লম্ব ভাবি, আসলে তা এমন নয়। মারাদোনা জানতেন, বুঝতেন, তিনি রাজা। এই রাজ্যপাট তার গড়া। ভাঙার অধিকারও তারই। অন্য কেউ তাকে কিছু পাইয়ে দেয়নি। যে জীবন পাইয়ে দেওয়ার, আপোষের, কামারের, তাকে স্যাকরার ঘা মেরেছেন তিনি, শুধু নিজের জন্যে নয়, সকলের জন্যে, এক বৃহত্তর ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা দেখেছি এক ছোট চারাগাছ নীলসাদা আকাশ ফাটিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে মহানীলে। জেনেছি, নেতা কেমন হবে।

যে লোকটা নিজেই নিজের স্রষ্টা, নিজেই নিজেই ঘাতক, সে দুর্মুখ হবে, কারণ তাঁর কারও কাছে দায় নেই, জীবন তাকে রাজপথে নগ্ন করেছে। সে অন্যেকে দেখবে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে, সাধুর মতো সৎ দৃষ্টিতে, শিশুর সারল্যে। ২০১৬ সালে, জীবন উপান্তে  মারাদোনাকে তাই পেলে জিজ্ঞেস করছিলেন,মারাদোনা মেসির সম্পর্কে তাঁর কী মত? মারাদোনা প্রশ্নটা এড়িয়ে যাননি। প্রশ্ন -উত্তরটা ছিল এই রকম-

– দিওগো, তুমি কি মেসিকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনো

– হ্যাঁ হ্যাঁ কিন্তু…

       -কী মনে হয় তোমার? উনি কি ভালো মানুষ। আমি ওঁকে খুব ভালো চিনি না, যতটুকু চেনার ওই…

       -হ্যাঁ, খুব ভালো মানুষ। কিন্তু সত্যি বললে ওঁর ব্যক্তিত্ব নেই। খুব বেশি ব্যক্তিত্ব নেই। মানে যতটুকু থাকলে একজন নেতা হওয়া যায়। 

       -আমি বুঝতে পেরেছি। মানে তুমি বলতে চাইছ আমাদের সময়ে অনেক খেলোয়াড়ের মতো।

       -হ্যাঁ এটাই বলতে চাইছি, ও অনেকের মতো।

– মনে আছে ১৯৭০-এর বিখ্যাত ফুটবলার রিভেলিনোকে। আমি ওঁর সঙ্গে মেসিকে নিয়ে কথা বলছিলাম। ও একই সুরে বলল, মেসি ভালো ফুটবলার এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু মেসির কোনো ব্যক্তিত্ব নেই।

কার সম্পর্কে এই কথা বলছেন মারাদোনা, যিনি ইতিমধ্যেই তিনটি বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছেন। প্রথম বিশ্বকাপে গোলও করেছেন। ২০১০ বিশ্বকাপে মেসি গোল পাননি। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে গোল করেন। পরের ম্যাচে ইরানের বিরুদ্ধে গোল ছিল তাঁর। ইরানের বিরুদ্ধে দলের একটি মাত্র গোল, সেটিও আসছে তাঁর পা থেকে। নীল সাদা ছেলের দল ফাইনালে হারছে মহাপরাক্রমশালী জার্মানির কাছে। তাছাড়া ততদিনে ক্লাব ফুটবলে নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছেন  মেসি। রোনাল্ডিনহোর মতো কিংবদন্তি ফুটবলার  পছন্দের তালিকায় প্রথম নাম বলতে বললে মেসির কথা বলেছেন। আর মাত্র দু’বছর পর বার্সিলোনাকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পাবেন তিনি।  তৈরি হয়ে গিয়েছে পেরিফেরিয়াল ভিশন, আজও যা স্তম্ভিত করে চলেছে বিশ্বকে।  এ হেন খেলার প্রতিভাকে কী করে ব্যক্তিত্বহীন বলেন মারাদোনা!

আসলে এই ‘ব্যক্তিত্বহীন’ শব্দের আড়ালে লুকিয়ে আছে মারাদোনার সেই শৈশব।  জীবনকে দেখার অন্য চোখ। রয়েছে পরিত্রাতা হয়ে ওঠার আখ্যান। মারাদোনা শুধুই লাবণ্যযোজনকে ফুটবল ভাবেন না। তাঁর কল্পনায় মহান্যায়ের দায় ফুটবলারের। সে এক দরিদ্র যিশু, যে প্রান্তজনের পরিত্রাণের জন্য জিনে ক্রুশ বইবে, রক্তাক্ত হবে, সমস্ত ক্ষতের মুখ সে বুজে দেবে গোলাপে গোলাপে। সে এক জেহাদি সিসিফাস যার অভিধানে  থামা নেই। সফল হওয়া ছাড়া অন্য কোনো অভিমুখ নেই। এই সাফল্য একক কীর্তি নয়। স্কোরবোর্ডের পরিসংখ্যান নয়।  এটা ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার পাশাখেলা।  মারাদোনা স্রেফ ফুটবলে নেই, স্রেফ মাঠে নেই, আছেন পরাভূতর সংস্কৃতিতে, জীবনসংগ্রামে। এই সত্যকে মনে রেখে চলাচল করার সময়ে যে  ছেলেটা স্টেশনের ধারে ডেনড্রাইট নেয়, ট্রেনে ভিক্ষে করে, ধুলোমাখা জার্সি পরে রাস্তায় ঘোরে, তাদের সবাইকে দেখে আপনার আমার মনে হবে, এ ছেলেটা তো মারাদোনাও হতে পারত। এই মনে হওয়াটাই মারাদোনার ব্র্যান্ড আইডেন্টি, ফুটবল ছাপানো, সমস্ত না পারা ছাপানো, দু.কুল প্লাবী। 

মারাদোনা মেসির মধ্যে ফুটবল পেরানো, ক্লাব পুঁজি আর গ্ল্যামার ছাড়ানো, সাধারণত্ব ছাড়ানো একজনকে দেখতে চান যার হাতে এক অদৃশ্য ন্যয়দণ্ড রয়েছে। যে দণ্ডের ছোঁয়াচে যুদ্ধ থেমে যেতে পারে, সব হারানো মানুষ একজন নেতাকে পেতে পারেন। মরণে আমরণে সেই নেতার প্রতি ভরসা রেখেই বাঁচতে পারেন। মারাদোনা তো নিজেই সেই সুদামসখা। তাঁকে যারা ভালোবাসেন, তারা এভাবেই ভালবাসেন। আজও খাদের কিনার থেকে একবার সব বিপদ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চান মারাদোনার জন্য। মেসি কি সেই জায়গা নিতে পেরেছেন? পেলের মতো, মারাদোনার মতো সেই ব্যক্তিত্ব কি মেসির আছে? এদোয়ার্দো গালেয়ানো লিখেছিলেন, “আমার মেসিকে ভালো লাগে কারণ মেসি নিজেকে মেসি ভাবে না।”  লিখেছিলেন, “ছেলেটা শিশুর মতো খেলে। খেলার আনন্দে খেলে। জেতার জন্যে খেলে না।”  মারাদোনার চোখে এটাই ভালোমানুষী আর ব্যক্তিত্বহীনতা। কারণ পরাজয় শব্দটাকে অভিধান থেকে উপড়ে ফেলে দিয়েছেন তিনি, যা চাই তা তিনি ছিনিয়ে নিয়েছেন। সেই সুদূর কৈশোরে দল থেকে বাদ পড়তেই ছিনিয়ে এনেছেন অনুর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ।  এল ফ্লাকো মোনেত্তিকে বাধ্য করেছেন তাঁকে দলে নিতে। সাংবাদিকদের সামনে স্পষ্ট বলেছেন, একমাত্র স্বপ্ন বিশ্বকাপ জেতা। গোলসংখ্যা দিয়ে বিচার করলে এই দার্শনিক প্রস্থানকে বোঝাই যাবে না।

মেসির জীবনেও তরঙ্গস্রোত কিছু কম ছিল না। বাবা একজন সাধারণ স্টিল কারখানার শ্রমিক। ছোটবেলা থেকেই গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি, যার জন্য সে সময়েই মাসে খরচ হতো ৯০০ ডলার। কিন্তু মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মেসি পৌঁছে গেলেন বার্সিলোনায়। পেয়ে গেলেন স্বপ্নলোকের চাবি।  ভালো ফুটবল খেললেন, ঈর্ষণীয় ফুটবলার হয়ে উঠলেন। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন। সমষ্টির দুঃখের নদী বেয়ে পারানি আদায় তাঁর হলো না। গোটা লাতিন আমেরিকার জয় পরাজয়ের সঙ্গে তিনি নিজেকে মিলিয়ে মেলে ধরতে পারলেন না। 

একমাত্র বিশ্বকাপ জয় এই না পারাটাকে মুছে দিতে পারে চিরতরে। এ কথাটা সবচেয়ে ভালো জানেন মেসি। তিনি জানেন, তিনি এমন এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যেখান থেকে সরে আসা চলে না। এই লড়াইটা সমষ্টির, কৌমের, সবার। বাংলাদেশের অখ্যাত মফসসলে চাকরি না পাওয়া যে ছেলেটা একটা রাত তাঁকে দিচ্ছে, এই লড়াইটা তারও। সেই কারণে মেসির হাবভাবে, অভিব্যক্তিতে আজ যা ধরা পড়ছে তা আর কখনও প্রকট হয়নি। গোল করছেন, করাচ্ছেন, কিন্তু তা তো তিনি করানই। মেসি এই প্রথমবার শাসন করছেন। নিয়ম ভাঙছেন। প্রয়োজনে হলুদ কার্ড দেখছেন, যা তার স্বভাভবিরুদ্ধ। বল ধরার মরিয়া তাগিদে শেষমেশ হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। জেতার পর ভ্যান গলের সামনে অদ্ভুত ভঙ্গিমা করে ট্রিবিউট দিচ্ছেন তাঁর বিস্মৃতপ্রায় সতীর্থ রিকেলমেকে। ইতিহাসকে। বিপক্ষের যাবতীয় প্রতিরোধ সমূলে নাশ করে ক্ষান্ত হচ্ছেন না। খেলা শেষে এসে জিজ্ঞেস করছেন, এত কথা কেন! বলতে চাইছেন, মাঠে মেসি খেলছে, তার আগে মন্তব্য করার তুমি কে হে! তাঁকে দেখে প্রথমবার মনে হচ্ছে, “বিরহে যদি দাঁড়িয়ে ওঠো, ভূতের মতো দেখায়!” কেবল খেলার আনন্দে খেলা নয়, এ কথাটা তার বলা সাজে, এখন এ কথাটাই তার বলার, মেসি বুঝেছেন। মারাদোনার ভাষায় যা ব্যক্তিত্ব, তার দ্যুতি মেসি ছড়িয়ে দিচ্ছেন গোলকময়। মেসির হাতে আজ রয়েছে সেই অদৃশ্য ন্যয়দণ্ড, যার ছোঁয়াচ পেলে মারী চলে যাবে, যুদ্ধবাজ থামবে কিছুক্ষণ, রিফিউজি শিশু খুঁজে পাবে ঘর। আমরা যারা চিরকালের হেরো, নেতা পেয়ে যাব এ জন্মের মতো।

Arka Deb

About Author

You may also like

দাশু আমাদের দাদা
Non-Fiction Writing

দাশু আমাদের দাদা

আমরা যারা নাম না জানা গঞ্জ মফসসলের ভূত, স্ট্যাম্পমারা বাংলা মিডিয়াম, মাস্টারদের ভাষায়- ছোট থেকেই দাগী, তাদের বড় হওয়ার কোনো
পাঠান সিনেমা নয় ভিডিও গেম
Non-Fiction Writing

পাঠান: সিনেমা নয় ভিডিও গেম

পাঠান প্রশ্নাতীত ভাবে সফল। বয়কট গ্যাংকে ফুৎকারে উড়িয়ে আসমুদ্রহিমাচল পাঠান-বন্দনায় অকৃপণ। শাহরুখ খান যেভাবে চার বছর পরে ফিরে এলেন তাকে

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.