Writing Non-Fiction

বহুত্ব আঁকড়ে বাঙালিয়ানার শিকড়-সন্ধান

বহুত্ব আঁকড়ে বাঙালিয়ানার শিকড়-সন্ধান

তাইল্যান্ডে ‘সোংক্রান’, কম্বোডিয়ায় ‘মহাসংক্রান্ত’, মায়ানমারে ‘থিংয়ন’, বাংলায় সংক্রান্তি। বিগতযৌবন বছরটাকে ফেলে আসে নববর্ষ। বনমর্মরে নুপুর বাজিয়ে, আমমুকুলের গন্ধে, বিকেলে ঝড়ের পূর্বাভাস নিয়ে যার আসা তাকে কী ভাবে বরণ করেছে বাঙালি? 

নববর্ষের দ্যোতনাবাহী শব্দ হালখাতা। হাল শব্দের একটি অর্থ লাঙল। কাজেই, কৃষকজীবন জড়িয়ে আছে নববর্ষের সঙ্গে, এমন অনুমান উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। মুঘল সম্রাটরা কৃষিপণ্যের  খাজনা নিতেন হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। অসময়ে খাজনা দেওয়ার যন্ত্রণা থেকে কৃষককে মুক্তি দিতেই সম্রাট আকবর ফসলি সন চালু করেন। এই ফসলি সনই বঙ্গাব্দ হয়ে উঠল কালক্রমে। বছরের শেষ দিনে কৃষক খাজনা পৌঁছে দেবেন জমিদারের ঘরে। ঝড় জলে ফসল নষ্ট হলে কর মুকুব করার চল ছিল। ঋণের ভার লাঘব করেই হোক বা ঋণ মুকুবের স্বস্তিতে, শূন্য থেজে শুরু হতো নতুন বছর। পুণ্যাহ বলে পরিচিত ছিল এই দিনটি। আবার, সঠিক সময় রাজস্ব জমা দিলে জমিদাররা নজরানা পেতেন, কাজেই সাজো সাজো রব দেখা যেত জমিদারবাড়িগুলিতে। নববর্ষ পালনের রেওয়াজ শুরু এভাবেই। অনেকেই জানেন না, এই যে হিজরি সন থেকে বঙ্গাব্দের প্রচলন, সেই হিজরি সন আবার হজরত মহম্মদের মক্কাত্যাগের সঙ্গে জড়িয়ে। মহম্মদের মদিনাগমনকেই হিজরতের শুরু ধরা হয়। অর্থাৎ এই উৎসবকে আর যাই হোক ধর্মীয় বিভেদ তৈরির জন্য ব্যবহার করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস নিজেই।

শুধু কৃষিনির্ভর গ্রামজীবনেই নয়, নগর কলকাতাতেও নববর্ষ পালনের হিড়িক দেখা যাচ্ছিল। হুতোম প্যাঁচার নকশায় পাওয়া যাবে তার ইঙ্গিত, “ইংরেজরা নিউইয়ারের বড় আদর করেন। আগামীকে দাঁড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান— নেশার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন। বাঙালীরা বছরটি ভাল রকমেই যাক, আর খারাপের শেষ হোক, সজনেখাঁড়া চিবিয়ে, ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে, পুরাণকে বিদায় দেন।” তবে বাংলা নববর্ষের চেয়েও শহর কলকাতা বেশি মজে থাকত চড়কে, বাবুবাড়ির গাজনে। নিম্নবর্গের মানুষ সেখানে পারফর্মার। উচ্চবর্ণ সেখানে আমুদে দ্রষ্টা। হুতোম লিখেছেন, “আমোদ সহজে ফুরোয় না, বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার ১২ দিনেও বিসর্জন হয় না। চড়কও ‘বাসী, পচা, গলা ও ধসা হয়ে থাকে’।” জোড়াসাঁকো, আহিরীটোলা, সোনাগাছি–রাস্তার ধারে ভিড় করে মানুষ গাজনের বানফোঁড়া দেখত। আইন করে নিষিদ্ধ করলেও সেই বানফোঁড়া বন্ধ করা যায়নি।

কৃষকসমাজ, পল্লিবাসীর পাশাপাশি এই উৎসবে জড়িয়েছে বণিক শ্রেণি। হালখাতা সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবেই। হাল শব্দটির আরবি অর্থ নতুন। মুর্শিদকুলি খাঁ-র সময় থেকেই হিন্দু-মুসলিম দু’সম্প্রদায়ের জমাখরচের হিসেব মধ্যসত্বভোগীরা যে খাতায় লিখেছেন তা-ই হালখাতা। বছরের প্রথম দিন জমা পড়া অর্থ- হালনগদ। মুসলমানি খাতায় লেখা: বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, এলাহি ভরসা। হিন্দুর খাতায় সিদ্ধিদাতা গণেশ বন্দনা, স্বস্তিক চিহ্ন। মুসলমান সমাজে দোয়া মাহফিল, মিলাদ মাহফিল, হিন্দু সমাজে সান্ধ্য অনুষ্ঠান, বর্ষবরণের সামাজিক রীতি ছিল এই। 

সমাজের সব অংশ যে উৎসবে জড়িয়ে যাচ্ছিল, সাংস্কৃতিক বুদ্ধিজীবীরা তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখবে কেন? শেষ শতকের দ্বিতীয় -তৃতীয় দশক থেকেই বইপাড়ায় নববর্ষ পালনের ধুম লেগে যায়। কল্লোল, শনিবারের চিঠি, এমসি সরকার হয়ে সেই আড্ডা ডালপালা মেলেছে। নববর্ষকে সাদরে অভিবাদন জানিয়েছে শান্তিনিকেতন। ১৯৩৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন এবং নববর্ষ অনুষ্ঠান একসঙ্গে  পালন শুরু হয়। উপলক্ষ্য শিক্ষার্থীদের দাবদাহ-র হাত থেকে বাঁচানো। শেষ জন্মদিনেও এই অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পঠিত হয়েছিল- সভ্যতার সংকট।

এখন, এই যে সর্বব্যাপী আয়োজন, ভাগচাষী থেকে নবাব, ব্যবসায়ী থেকে কলমবাজ, সমাজের সবার জন্য যে উদযাপনের বন্দোবস্ত কালে কালে তা কোথায় এসে ঠেকল? বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ- বাংলা মাসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কতটুক? বাঙালি অস্মিতা আমাদের মনে আদৌ দাগ কাটে? ধুলোমলিন, শ্রীহীন পরিত্যাজ্য বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি রইল কি গেল, তা নিয়ে মাথাব্যথা আছে জেন -জেড-এর? সর্বোপরি, শয়নেস্বপনে মুসলিম ঘৃণার আফিমসেবনে অভ্যস্ত বর্ণহিন্দু বাঙালি সমাজ কি নববর্ষের এই যৌথতার নিরুচ্চার আমন্ত্রণ শুনতে পায়? গোটা দেশে যখন বাঙালি অপরায়ণের হাওয়া ক্রমে বাড়ছে, তখন মোবাইলে মঙ্গলবার্তা চালাচালির চেয়েও  এই দিনটির মাহাত্ম্য যে অনেক বেশি তা কি আমরা ভাবতে পারি? 

ভাবতে পারলে, পার্কসার্কাস, গার্ডেনরিচকে অন্যগ্রহ মনে হতো না। রাজনৈতিক নেতারা মুসলমানি চিহ্নগুলিকে আক্রমণ করলে, বাঙালি ভাইয়ের জন্য গলা তুলত আরেক বাঙালি, তার ধর্মপরিচয়  যাই হোক না কেন। বাঙালিয়ানা শক্তিসঞ্চার করত অজুত মনে। এমনকি ধুতি পাঞ্জাবি মিষ্টিদইয়ের মতো বাঙালিয়ানার ক্লিশে চিহ্নগুলিতে আটকে না থেকে সে আরও জাতিচিহ্ন খুঁজত, খুঁজে তার শ্রেষ্ঠত্ব দেশের বাজারে প্রতিষ্ঠা করে জাতির মেরুদণ্ড শক্ত করার কথা ভাবত। বলাই বাহুল্য আমরা তা পারিনি।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নববর্ষকে নিছক ইওরোপীয় হ্যাপি নিউ ইয়ারের বঙ্গজ সংস্করণ হিসেবে দেখেননি কখনও। নববর্ষ তাঁর চোখে প্রবৃত্তির দায়মুক্ত হয়ে অন্তরে উদ্ভাসিত জীবনের দিকে যাত্রা। ইংরেজি নববর্ষের সঙ্গে ফারাক বোঝাতে লিখছেন, ‘আমাদের নববর্ষ এমন সহজ নয়, এমন কোমল নয়, শান্তিতে পরিপূর্ণ এমন শীতল মধুর নয়’। স্বাভাবিক, জানুয়ারির আবহাওয়া আর চৈত্র-বৈশাখের আবহাওয়াও যে এক নয়। স্বস্তি বলতে শুধু, বিকেলের দমকা হাওয়া, সর্বব্যাপী ঝড়। এই ঝড়ের জয়ধ্বজা উড়িয়ে যে এসেছে আজ, তার থেকে কী শিখব? রবীন্দ্রনাথ বিধাতার ইচ্ছে স্মরণ করিয়ে বলবেন, ‘ভূমার মধ্যে তোমার প্রকাশ হোক’। ভূমা শব্দটির আভিধানিক অর্থ-বহুত্ব। বহুত্ব আঁকড়ে বাঙালিয়ানার শিকড়-সন্ধান। আমরা কি পারব এই নববর্ষে শপথ নিতে?

Arka Deb

About Author

You may also like

article
Interview Writing

Hands-On With Borderlands 3 And 2 New Vault Hunters

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected
article
Interview Writing

Tesla’s Cooking Up A New Way To Wire Its Cars, Report Says

There are many variations of passages of Lorem Ipsum available but the majority have suffered alteration in that some injected

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.