একজন ফ্যাসিবাদী কেমন দেখতে হবেন? কেন, যেমন দেখতে হিটলার বা বেনিতো মুসোলিনি! চোখে থাকবে নিষ্ঠুরতা, হাতে রক্তের দাগ। জলপাই পোশাক পরে মানুষের খুলির উপর দাঁড়িয়ে প্রসন্নমুখে বরাভয়ের হাতখানি তুলে ধরবেন আদর্শ ফ্যাসিস্ট নেতা। অনুগত ভৃত্যরা তারই জয়গান গাইবে। সকলে জানে, ব্যাকরণ অনুযায়ী ব্যাপারটা এমনই। কিন্ত ইতিহাস নিজেই নিজের সংরূপ বদলায়। ইতিহাসের তামাত অধ্যায় থেকে ব্যবহারিক শিক্ষা নেন রাজনীতির ব্যাপারীরা। ভারতীয় রাজনীতির একাল-সেকালের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের নিবিড় যোগের দিকে যদি কেউ তাকায়, দেখা যাবে এদেশে এই তত্ত্ব এতটা মোটাদাগের কপিবুক গেম নয়, এ দেশে তা এসেছে সন্তর্পণে, গিরগিটির মতো, কখন কোন রঙে অবতীর্ণ হতে পারে সে কথা আগেভাগে জানত না কেউ। রাজনীতির ব্যাপারীরা ফ্যাসিবাদের ছোট ছোট লক্ষণগুলি নীরবে আত্তীকরণ করেছেন, প্রয়োগ করেছেন আড়াল রেখে। নিস্পৃহ হয়ে বললে, ইন্দিরা গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদী জমানা, ভারতের রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্রে ক্রমেই অনুকূল আবহাওয়া পেয়েছে একধরণের চোরা ফ্যাসিবাদ, পরিভাষায় আজ যাকে বলা হচ্ছে স্পিন ডিক্টেটরশিপ। এই চোরামার কখন কী ভাবে নেমে আসবে, জনতা তো বটেই, শাসকের অতি ঘনিষ্ঠজনও জানতে পারেন না অনেক সময়। যখন স্বরূপ উন্মোচিত হবে, ততদিনে মানসলোকে রাজমূর্তিটি পাকা স্থান দখল করে নিয়েছে, টেনে নামানোর মন মরে গিয়ে জেগে রয়েছে অবনত ভক্তিপ্রবণ সমর্পিত হৃদয়।
ধরা যাক ইন্দিরার কথাই। জওহরলাল কন্যা যে জরুরি অবস্থা প্রণয়ন করতে পারেন তা জানত না তাঁর অতি ঘনিষ্ঠমহলও। ইন্দিরা রাতারাতি ৩৫২ নম্বর ধারা প্রণয়ন করে ৫৯ জন সাংসদকে গুমঘরে পাঠিয়ে দিলেন। রেহাই পেল না সংবাদমাধ্যম। বিচারব্যবস্থা, নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সমস্ত পূর্ব-ধারণা ধুলিসাৎ হলো চোখের নিমেষে। কিন্তু ততদিনে তো ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। যে দেবীমূর্তি মর্মে অধিষ্ঠিত, তাকে কী করে ফ্যাসিস্ট বলবে মন!
নরেন্দ্র মোদীও তেমন। তাকে ফ্যাসিস্ট বলতে মন সরে না। তিনি পুলওয়ামার মধুরতুমুল বদলা সম্ভব করেছেন, তিনি চিনকে টাইট দিয়ে রেখেছেন, কী ভাবে আমি ভাবব নোটবন্দির মতো সিদ্ধান্ত যে তিনি নিয়ে ফেলেছেন তা তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও জানতেন না। আমি কী ভাবে ভাবব এই কাউকে বিশ্বাস না করা, মন্ত্রীদের ক্ষমতাহীন জনসংযোগ আধিকারিক বানিয়ে রাখাটা — ফ্যাসিবাদের বড় লক্ষণ। তার চেয়ে বরং মূর্তি গড়া ভালো। কারো মনে তিনি ফকির। কারও মনে তিনি সাধক, বৈরাগী। কেউ আবার এক পা এগিয়ে বলছে বিশ্বগুরু। গোটা বিশ্বকে আলো দেবেন এমন নেতা।
বাঙালি কবিগুরু জানে। বিশ্বকবি জানে। কিন্তু বিশ্বগুরু নামক ধারণার সঙ্গে তার এ যাবৎ খুব রুস্তমকুস্তম, এমনটা বলা যায় না। বাঙালির আসল কবিগুরু জাতীয়বাদের মতো বিষয়কে গোড়াতেই নাকচ করে দিয়েছেন। লোকে ক্ষুণ্ন হয়েছে, জাপানের মতো জাতীয়তাবাদী দেশে মুখ খুলে বিদ্রুপ সইতে হয়েছে, কিন্তু এ বান্দার মন টলানো যায়নি। অর্থাৎ ইতিহাসগত কারণেই জাতির মনে অধরা থেকে গিয়েছে প্রজেক্ট বিশ্বগুরু। একদিকে না জানা, অন্য দিকে আইকন-অন্বেষণ, এই আবহেই আজ সিঁদ কাটছে ছায়া ফ্যাসিবাদ, স্পিন ডিক্টেটরশিপ। দেখতে গণতন্ত্রের মতোই, রন্ধ্রে প্রবেশ করছে স্বৈরাচারের বিষ।
হিটলার যেমন আর্যশ্রেষ্ঠ দাবি নিয়ে মাঠ বড় করতে নেমেছিলেন, মোদীকে সামনে রেখে এই প্রজেক্ট বিশ্বগুরু অনেকটা তেমনই, হিন্দু জাতীয়তাবাদের নিঃসংশয় শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর নেতৃত্বের ঘটপ্রতিষ্ঠা। ইন্দিরার সময়ে বলা হতো, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, আর আজ আমরা জানি, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। অসাধ্যসাধনে কোনো যুক্তি লাগবে না, লাগবে দৈব ম্যাজিক। মোদী-ম্যাজিক শব্দবন্ধটি অক্সফোর্ড অভিধানে যে কোনো দিন অন্তর্ভুক্ত হবে। কেমন এই ম্যাজিক? অলৌকিক বিভূতি, কাসরঘণ্টা বাজছে, লোকে করতালি দিচ্ছে, হিতাহিত জ্ঞান যাবে যাবে করছে, যজ্ঞের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে, ম্যাজিশিয়ান শান্ত, সমাহিত, এসবের মাঝে হুঁশ করে উড়ে গেল চন্দ্রযান। মোদী ছিলেন বলেই হয়েছে। কিন্তু ইসরোর সাফল্য যদি মোদীর সাফল্য হয়, নোটবন্দি, রাফাল কেলেঙ্কারি, গৌতম আদানির সংস্থার কার্যকলাপ, পরিযায়ীর রক্তে ঘামে ভাসা লকডাউন, ভয়াবহ কর্মসংকোচন – মোদীরই ব্যর্থতা নয় কি? কিন্তু আমরা খারাপগুলি দেখব না, তিনি পরমপুরুষ, শ্রেষ্ঠ আর্য। বিশ্বগুরু। বিবেকানন্দ যা পারেননি, রবীন্দ্রনাথ যা পারেননি, তিনি তাই করে দেখিয়েছেন, বুকের মধ্যে বিশ্বলোকের সাড়া পাই তাঁরই বাজারসফরের কল্যাণে। যা কিছু তাঁর ইমেজের বিপ্রতীপে, আমরা তাঁর থেকে দূরে দূরে থাকব, গা বাঁচাব। কোনো প্রশ্ন করব না। পাছে মূর্তি ভেঙে যায়!
কিন্তু এই যে আকাশ ছাপানো মূর্তি নির্মাণ- প্রবীণ সর্বজ্ঞ এক মহর্ষির আবির্ভাব, এ তো একদিনে হওয়ার নয়, শতাব্দীর সংকল্প। ২০২৫ সাল আরএসএস-এর শতবর্ষ। মোদীর জয়ের হ্যাট্রিক আর সঙ্ঘের সেঞ্চুরি, এই রাজযোটক হলে বিশ্বগুরু তত্ত্ব শাশ্বত হয়ে যাবেই। তাই চাই দূরদৃষ্টি, পরিশ্রম। মোদি শ্রমে কোনো ঘাটতি রাখেননি। মেলে ধরেছেন দুটো ডানা। কী ভাবে? উপস্থিত এবং নীরবতা-এই দুই ব্রক্ষ্মাস্ত্রের ব্যবহারে।
১৯৯০ সালে রথযাত্রার সময়ে নরেন্দ্র মোদী- লালকৃষ্ণ আদবানীর একটি ছবি তোলা হয়। সেখানে ছবির ফোকাসে ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানী। ছবি কথা বলে। আমরা দেখতে পাই, মোদী যেন ঈষৎ বিমর্ষ, তিনি আলোয় থাকতে চান, একমেবঅদ্বিতীয়ম উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে চান। ২০০২ সালে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে দেখা গেল চাওয়ার জোর। উপস্থিতির শক্তি। মোদী বলেন। শোনেন না। কাগজে-দেওয়ালে সর্বত্র তাঁকে দেখতে হয়।এই যে একমুখী সংযোগ প্রক্রিয়া, এর মধ্যে দিয়েই তিনি একটা বড় অংশের কাছে উঠেছেন মনুষ্যেতর এক চরিত্র। বিকাশপুরুষ, হিন্দুহৃদয় সম্রাট থেকে চাওয়ালা-অষ্টোত্তর শতনাম তাঁর। করোনার সার্টিফিকেট পাচ্ছে দেশবাসী, তাতে মোদীর ছবি। নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের পরেও পেট্রল পাম্পে জ্বলজ্বল করে তাঁর ছবি। যেখানেই বন্দে ভারত উদ্বোধন, তিনি চলে যান। সাম্প্রতিক আরটিআই বলছে, তিরুঅনন্তপুরম এবং তামিলনাড়ুতে বন্দেভারত-কে সবুজসংকেত দেওয়া, অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া– সব মিলে তাঁর উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে খরচ হয়েছে মোট দু’কোটি ষাট লক্ষ টাকা।
মোদি জানেন, যদি হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে। তাই অন্তত ১৫টি কেন্দ্রীয় যোজনার শুরুতে পিএম শব্দটি খোদাই করা হয়েছে। যেন পিএম (প্রাইমমিনিস্টার) মানেই তিনি, এই বোধটা রন্ধ্রে ঢুকে যায়। এই যোজনাগুলির অনেকগুলিই কিন্তু মনমোহন জমানার। এর সঙ্গে রয়েছে মন কি বাতের ঢক্কানিনাদ। প্রতিটি বিজেপিশাসিত রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীদের ছবিতে পাশে থাকেন তিনি। প্রতিটি আয়ুষ স্টোরে ঝোলে তাঁর মুখচ্ছবি।
এই মোদীই গোরক্ষার্থে গণপিটুনি নিয়ে কখনও কোনো কথা বলেন না। দেশীয় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না। প্রেস কনফারেন্স করেন না। দেশের বাইরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি তিনি প্রেস কনফারেন্সে হাজির ছিলেন। উত্তর দিয়েছেন একটি প্রশ্নের। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক সাংবাদিক তাঁকে কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন করলে তাঁকে তুলধোনা শুরু করে ট্রোল আর্মি। যেখানে উত্তর দেওয়ার বা জবাবদিহির ব্যাপার আছে, সেখানে তিনি নীরব। যে গৌতম আদানির সঙ্গে ছ’বছরে ১৮ বার বিমানসফর করেছেন, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে আসার পরে তাঁর বিষয়ে মুখে কুলুপ মোদীর। দেশের সেরা কুস্তিগীররা যখন রাস্তায় বসে বিজেপি সাংসদ ব্রীজভূষণ শরণ সিং-এর বিচার চাইছেন, তখন মোদী নীরব। মণিপুর নিয়ে দীর্ঘসময় চুপ থাকার পর তিনি ব্যয় করলেন মাত্র ৩৬ সেকেন্ড। নীরবতার রাজনীতি দিয়েই তিনি পক্ষ-বিপক্ষ নির্মাণ করে দেন।
ব্র্যান্ডবিল্ডিং এমনই, পক্ষে আছেন যারা তারাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অস্ত্র ধরবে। দীর্ঘ দুই দশকের উপস্থিতিতে অভিভূত মানুষের মানসলোকে আচ্ছে দিন এসে গিয়েছে। তারা জানে, বিরুদ্ধবাদকে গলা টিপে মারতে হবে। জানে বিরুদ্ধাচারণ করা সাংবাদিককে পাকিস্তানে চলে যেতে বলতে হবে। জানে, গোরক্ষার অজুহাতে খুন করাটাই দস্তুর। জানে তথ্য যাচাইয়ের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। জানে মোদীপক্ষ থেকে যে বার্তা আসছে তার ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুদায় একমাত্র তার। এই হল স্পিন ফ্যাসিবাদের অপচ্ছায়ার ক্রমসম্প্রাসরণ।
শাসক বলছে, শাসকের ছত্রধর বলছে। মানতে হবে। তারপরেও যদি কেউ ২+২=৫ মানতে না চায়, কেউ যদি বলে, কীসের আচ্ছে দিন? অক্সফাম রিপোর্ট (২০২১) তুলে যদি কেউ দেখায়, দেশের ৪০.৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে দেশের ১ শতাংশের হাতে, আর ৭০ কোটি লোকের জন্য বরাদ্দ দেশের মাত্র তিন শতাংশ সম্পদ? কেউ যদি বলে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে সমৃদ্ধি বলে দেখানোটা আসলে মস্ত ফাঁকি, কারণ মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে অনুপাত করলে দেখা যাবে সুবিধেজনক জায়গায় নেই ওই ৭০ কোটি? এই ৭০ কোটি কি বিকাশের অংশ নয়? সবাই মানে কি স্রেফ উঁচুতলা? এসব কথা বললে কি দেশদ্রোহিতা হবে? কারও মনে যদি প্রশ্ন আসে আরে কীসের আচ্ছে দিন, এই জমানাতেই তো ৪৫ বছরের সর্বোচ্চ বেকারত্ব স্পর্শ করেছে এই দেশ? এই আমলেই তো ধর্ষকের মুক্তিতে পটকা ফাটল দেশে আর ধর্ষিতার পক্ষে যে সেই তিস্তা শীতলাবাদকে হাজতে যেতে হল? কেউ যদি জানতে চায়, কেমন আছেন শার্জিল ইমাম, বাড়িতে ফোন করতে পান তিনি? কেউ যদি জানতে চায়, কেন মৃত্যুকালে স্ট্র পাননি স্ট্যান স্বামী? জানতে চাওয়ার মাশুল হিসেবে তাঁকে একঘরে হতে হবে? তাঁর চাকরি যাবে? তাঁর পিতৃশ্রাদ্ধ হবে না তো ফেসবুকে? অপতথ্যের আর হিংসার কুঠার হাতে ছুটে আসবে না মোদী-ম্যাজিকে আচ্ছন্নরা?
আর্যশ্রেষ্ঠদের নিয়ে দেশ গড়ার স্বপ্নে বুঁদ হিটলার গণহত্যার ব্যাপারে কোনো ‘কার্পণ্য’ করেননি। নির্বিচারে মেরেছে তার বাহিনী। ইহুদি, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি, কেউ বাদ যায়নি। অপর দেখলেই গুলি চালিয়েছে গেস্ট্যাপোরা। একজন ছায়াফ্যাসিবাদীও নিজে গুলি চালাবে না। তার নামে জয়ধ্বনি তুলে রাষ্ট্রীয় উর্দিধারী অথবা কোনো নেশাতুর ভক্ত স্থলে-জলে গুলি করে দেবে অপরকে, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে, বলবার কথা, মিলের দিক এইটুকুই।