Writing Non-Fiction

ফেসবুকেই স্পন্দিত বিপ্লবের পদধ্বনি? 

ফেসবুকেই স্পন্দিত বিপ্লবের পদধ্বনি?

বিশ শতকে বহুল প্রচলিত প্রবাদ মুখেন মারিতং জগত একুশে এসে আরও ছিমছাম, স্মার্ট, ধারালো হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একই শ্লেষ প্রয়োগের বাসনায় লোকে এখন ছুঁড়ে দিচ্ছে অপেক্ষাকৃত নতুন লব্জ: ফেসবুক বিপ্লবী। ‘মুখ’ হয়েছে সোশ্যাল হ্যান্ডল, আর জগতের ভার্চুয়াল সংস্করণ: ভুবনগ্রাম। শত সহস্র অজুত নিযুত মুখ-মুখোশের ভিড়ে কেউ কেউ তার চারপাশ দ্বারা চিহ্নিত হন ফেসবুক বিপ্লবী হিসেবে, ঠিক যেমন সমাজে কেউ কেউ- মুখেন মারিতং…। সমাজের হাতেগরম প্রোটোটাইপ স্মার্টফোনে নিয়ে ঘুরছি, যখন খুশি ছ’শো জনকে জুটিয়ে নিচ্ছি, কথা বলছি টালা থেকে টোকিও রেঞ্জে, গোটা পৃথিবীর ভালো খারাপে গা ভাসাচ্ছি, গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কার বা শিল্পবিপ্লবের চেয়ে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এই ঘটনা। আর সেই হলাহল মন্থনেই উঠে এসেছে দীর্ঘশ্বাস, শ্লেষ, বক্রোক্তি: ফেসবুক বিপ্লবী। দুটো প্রশ্ন জাগিয়ে দেয় এই লব্জ। এমন ট্যাগ কাদের কপালে জোটে? বিপ্লব কি সত্যিই ফেসবুকে সম্পন্ন হওয়া সম্ভব? উত্তর খুঁজতে প্রথমে বুঝতে হবে ফেসবুকের চরিত্র।

জগতের আনন্দযজ্ঞে আমি আছি না নেই, আমার উপস্থিতির ভার ঠিক কতটা তা জানান দেওয়ার ইচ্ছে সব মানুষের মধ্যে রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে আদিম কৌতূহল। এই জানার এবং জানানোর ইচ্ছের সাঁড়শি চাপে সে মর্নিং ওয়াকের আছিলায় কুয়াশাজর্জর সকালে বিছানা ছেড়ে চায়ের দোকানে যায়। ছাদের কাপড় শুকনোর অজুহাতে চুয়াল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সইয়ের সঙ্গে কথাচালাচালি করে। কেউ দুটো ভালো কথা বললে, পিঠ চাপড়ে দিলে দুপুরে সামান্য বেশি ভাত, আর বাঁকা কথা ধেয়ে এলে সন্তানের বাপবাপান্ত। সমাজ বলতে ছিল এই। সেখানে হর্ষ বিষাদের তরঙ্গের রুটিন বাঁধা যাতায়াত ছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াই প্রথম মানুষকে আবেগ ম্যানিপুলেশনের সুযোগ দিল। সে প্রত্যক্ষ ভাবে না জানলেও অনুভব করতে পারল হর্ষ বা বিষাদ এই দুই বোধকেই কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোনো গভীরতর প্রাপ্তিতে আমাদের মন যেমন তৃপ্তিতে ভরে যায়, তেমনই তৃপ্তির বোধ ফেসবুক দিতে পারে অহরহ, যদি বরাত ভালো থাকে, প্রাপ্তির আড়বহর যাই হোক না কেন। ফলে এই কোকেনে মজল গোটা বিশ্ব। ডোপামিনের স্রোত বইয়ে দিল ফেসবুক। এই ফেসবুকে উপস্থিতি-অনুপস্থিতি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে ব্যক্তিকে বুঝতে চাওয়ার সূচক হয়ে দাঁড়াল। ভাইরাল, ইনফ্লুয়েন্সার, সোশ্যাল মিডিয়া স্টার এই ধরনের শব্দগুলি পরিভাষা কোষে জায়গা নিল। 

যারা এই ক্রমবিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না বা চাইছেনও না তাদের কাছে এই সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবশালীরাই ‘অস্পৃশ্য’, ‘বিপ্লবী’। বলার সময় মুখ বেঁকিয়ে বলা হয় অমুক সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখে। তমুক ফুড ব্লগ করে। মানে বলতে চাওয়া হয়, ওরা তেমন ‘জাতে ওঠেনি’। প্রশ্ন করতে হয়, তারা কি কম্পিউটারের বদলে খাতা লেখা বা বোতাম টেপা ক্যালকুলেটরকেই এগিয়ে রাখেন এখনও? তারা কি তাল রাখতে না পেরে ঈষৎ বিমর্ষ আর ঘোর অনিশ্চিতায় ভুগছেন তাই ঘনঘন আক্রমণ শানাচ্ছেন? সমাজে তারাও কি নিজেদের প্রভাবশালী হিসেবে দেখতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন না?

যতই কুলীনরা ফুটিয়ে দিক, সাফ কথা বিপ্লব ফেসবুকে একটা হয়েছে। সমাজ যাঁকে এলেবেলে বলে পাত্তা দেয়নি, কান মুলেছে যত্রতত্র, কালো বলে শুয়োর বলেছে, সে তার গুণের পসরা ফেসবুকে সাজিয়ে বসতে পেরেছে নির্দ্বিধায়। ফেসবুক তাকে নিত্য আত্মোৎঘাটনের সুযোগ দিয়েছে। দিয়েছে স্বীকৃতি। নিজের সমাজ তৈরি করে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। ফলে যার কথা শুনে ভালো লাগছে না, যার সাফল্যে ঈর্ষা হচ্ছে তাঁকে ফেসবুক বিপ্লবী দাগিয়ে দিয়ে বুকের জ্বালা খানিকের জন্য জুড়োতে পারে কিন্তু সাবঅল্টার্নও কথা কইতে পারে, প্রমাণ ফেসবুক। স্পষ্ট কথা, ব্যবহার করতে জানলে সোশ্যাল মিডিয়া মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। বিনামূল্যে নিরন্তর জানার সুযোগ বিপ্লবেরই নামান্তর। শুধু তাই নয়, অতিসামান্য পুঁজি নিয়ে মানুষ ফেসবুককে ব্যবহার করে তার পণ্য গোটা পৃথিবীর সামনে প্রদর্শন করছেন, বিপণন করছেন, মাসান্তে আয় করছেন এমন উদাহরণ পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে। 

মনে পড়ছে আরব বসন্তের কথা। ইন্টারনেট তথা সোশ্যাল মিডিয়াই কিন্তু সেখানে একজোট করেছিল প্রতিবাদীদের। শাহবাগ আন্দোলনকারীরাও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছেন। ভারতে এনআরসি সিএএ আন্দোলনও সুসংহত হয়েছে ফেসবুক-সহ তামাম সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে। বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে রাহুল গান্ধীর উত্থানের চাবিকাঠি যদি ভারত জোড়ো যাত্রা হয়, তবে তার প্রচারভূমি হয়ে উঠেছে এই ফেসবুকই। রাহুল গান্ধির সোশ্যাল প্রোফাইলের জেটগতি কী ভাবে আটকানো যায়, তা নিয়ে  শাসকদলের মাথাব্যথার শেষ নেই। এমনকী হালের আরজিকর আন্দোলনও দানা বেঁধেছে এই ফেসবুকেই। 

ফলে  ‘ফেসবুক বিপ্লবী’ জাতীয় টিপ্পনী কাটা সাবর্ণসমাজ দিনশেষে করুণার পাত্র হয়েই থাকবেন। নিজেরাও চেষ্টা করবেন এই ফেসবুকেই থই পাওয়ার। ফেসবুককে বাতিল, ফেসবুকে প্রতিপক্ষকে খারিজ করার জন্য দাগিয়ে দেওয়া সংকীর্ণ দক্ষিণপন্থার নামান্তর ধরে নিয়েও দু’টি কথা বলতে হয়। প্রথমত, ফেসবুক যেমন বহুমতকে মর্যাদা দিয়েছে তেমনই এখানে সেই সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদই কায়েম হয়েছে। যে মতটি বহুজন সমর্থিত সেটিই এখানে ভেসে থাকবে, অন্য মতটি হারিয়ে যাবে, সহজে বললে একেই বলে অ্যালগোরিদম। আর অন্যমতের প্রচারকারী ট্রোলড হবে, এটাই নতুন সমাজবাস্তব। সে মিডিয়াকর্মী হলে তাঁকে বলা হবে ‘প্রেস্টিটিউট’। সংখ্যালঘু হলে তার ধর্মপরিচয়ের জন্য তাকে কোনঠাসা করা হবে। ভারতবর্ষ, মায়ানমার, বাংলাদেশ- এই সত্য সব দেশের। দ্বিতীয়ত, ফেসবুক যেমন বিপ্লবে ইন্ধন জুগিয়েছে তেমনই হাত শক্ত করেছে প্রতিবিপ্লবের, রাষ্ট্রশক্তির। বারবার রাজনৈতিক দলগুলি, রাষ্ট্রনেতারা ফেসবুক ব্যবহার করে কী ভাবে গুজব ছড়িয়েছেন, হিংসায় ইন্ধন দিয়েছেন, মানুষকে দেশছাড়া করেছেন, ব্যক্তিস্বার্থে এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করেছেন সে ইতিহাস আজ নথিবদ্ধ হয়েছে। 

ফেসবুক-সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের আঁতাতে গড়ে ওঠা নয়া অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে সুজানা যুবফ নাম দিয়েছেন নজরদারি পুঁজিবাদ। এক কথায় বললে, যে উপভোক্তা ভাবছে সে ফেসবুককে ব্যবহার করছে, আসলে ফেসবুকের পণ্য সে-ই। তার ওয়াচটাইম। সে যাতে বারবার এই মাধ্যমে ফিরে আসে তা সুনিশ্চিত করতে নজরদারি চালায় ফেসবুক। সোশ্যাল ডিলেমা নামক তথ্যচিত্র এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য।

কাজেই আত্মবিকাশের জন্যে, একজোট হওয়ার জন্যে ফেসবুক থাকুক। কিন্তু গায়ে রোদ লাগুক, পথ হাঁটার অভ্যেসগত প্রতিবর্তক্রিয়া হারিয়ে গেলে পূর্বপুরুষের চেষ্টায় অর্জিত শিরদাঁড়া ক্রমে নুইয়ে যাবে।

Arka Deb

About Author

You may also like

দাশু আমাদের দাদা
Non-Fiction Writing

দাশু আমাদের দাদা

আমরা যারা নাম না জানা গঞ্জ মফসসলের ভূত, স্ট্যাম্পমারা বাংলা মিডিয়াম, মাস্টারদের ভাষায়- ছোট থেকেই দাগী, তাদের বড় হওয়ার কোনো
মারাদোনা থেকে মেসি
Non-Fiction Writing

মারাদোনা থেকে মেসি

চোখ যতই উজ্জ্বল হোক, যতই থাকুক মুসকো গোঁফ, ঠেলায় না পড়লে বেড়াল কখনও বাঘ হয় না। হঠাৎ একদিন কেউ সমুদ্রের 

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.