Writing Non-Fiction

প্রমাণ করে দিতে হবে, আই অ্যাম নট মুসলিম

প্রমাণ করে দিতে হবে, আই অ্যাম নট মুসলিম

জন্মের ১২৫ বছরে কাজী নজরুল ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে টুকরোটাকরা লেখা চোখে পড়ছে। যে কাগজে নজরুল হয়তো চারের পাতায়, সেখানেই কাগজের শুরুতে কাঁওয়ার যাত্রা। যে যাত্রা নিয়ে উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড সরকারের ফতোয়া দিয়েছিল, যাত্রার পথের ধারে দোকানদারদের নাম এবং পরিচয় উল্লেখ করতে হবে। এই বিবৃতির অস্যার্থ: খাবার বিক্রেতার ধর্মপরিচয় জানাতে হবে। জানাতে হবে, তুমি হিন্দু নাকি মুসলিম। আরও স্পষ্টভাবে বললে, শাসক চায় মুসলিম-মুক্ত যাত্রাপথ, প্রমাণ করে দিতে হবে, আই অ্যাম নট মুসলিম। কাগজ বন্ধ করে মনে পড়ে নজরুলের পঙক্তি: “হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? 

কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।” এক্ষেত্রে কান্ডারী হয়তো সুপ্রিম কোর্ট, যে প্রতিষ্ঠান শেষমেশ এই ফরমান রুখে দিয়েছে, হয়তো মহুয়া মৈত্রর মতো দু’একজন ব্যতিক্রম, যারা এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা এতটুকুও কমেনি। ধর্মের আফিমখেকো মানুষবোঝাই জাহাজ যে ভাবে হিমশৈলকে ধাক্কা মেরে ডুবছে, তাতে নাবিক সেই জাহাজ বাঁচাতে পারবে কিনা সন্দেহ।

ভোট দেবে যে জনগোষ্ঠী তাকে আটকে রাখতে, একটি প্রতিপক্ষ নির্মাণ করতে, পক্ষকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে  লেলিয়ে দিতে একটি চুম্বক তৈরির কাজ অ্যাডলফ হিটলার করেছিলেন জার্মানিতে।  কী ভাবে ক্রমে সুর চড়িয়েছিলেন হিটলার? ১৯২৩ সালে মিউনিখ ভাষ্যে হিটলার বলেন, ‘ইহুদিদের বিষয়টা জাতিগত প্রশ্ন। উত্তরটাও জাতিগত ভাবেই দিতে হবে।’ অর্থাৎ জার্মানদের অপরায়নের ডাক দেওয়া হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মিটতেই। এর দু’বছর পর প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্পে দেখা যায় হিটলার লিখছেন, ‘ইহুদি কোনো ধর্ম নয়, এটা একটা জাতিগত পরিচয়।’ হিটলারের এই ইঙ্গিতগুলিকে প্রথম প্রথম স্বজাতির প্রতি অনুরাগ ভেবেছিলেন অনেকে, তাঁর মন কি বাত-এ সায় দেওয়ার লোক জুটে গিয়েছিল অনায়াসেই। জার্মান জনতা বলতে শুরু করে, এই লোকটা আমাদের কথা ভাবছে। দশ বছর পর এই হিটলার বার্লিন বক্তৃতায় বলবেন, শেষ ইহুদিটিকে জার্মানি ছাড়া করে থামব। নুরেমবার্গে তাকে বলতে শোনা যাবে, ‘ইহুদিরা মানবতার শত্রু।’ ১৯৩৮ সালে মিউনিখ বক্তৃতায় হিটলার বলছেন, ‘আমি আবেগে গা ভাসাব না। ইহুদিরা জার্মানদের ঘোষিত শত্রু’। দেখা যাচ্ছে, হিটলার প্রথমে জাত্যাভিমানে হাওয়া দিলেন, তারপর শত্রু শণাক্ত করলেন, তারপর শত্রুর বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা ছড়ালেন, জাত্যাভিমানীরা হয় চুপ হয়ে গেল অথবা বললেন বেশ হয়েছে। ‘দ্য সাইকোলজি অফ অথরিটারিয়ানিজম’ গ্রন্থে শাসক ক্ষমতা বাড়াতে, ঈশ্বরকল্প নির্মাণ করতে কী ভাবে এই চুম্বকায়ন ব্যবহার করে তা বিশদে বর্ণনা করেছেন বব আল্টেমেয়ার।

জার্মানদের থেকে ইহুদিদের  আলাদা করা হবে কী ভাবে? হিটলার কয়েকটি পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথমেই আইন করে ইহুদিদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়।  ন্যুরেমবার্গ আইনে বলা হয়, যার প্রপিতামহ ইহুদি, যে নিজে জুডাইজম অভ্যেস করে সেই ইহুদি। কিন্তু সকলে তো এ কথা স্বীকার করবে না, ভয় দেখালে চেপে যাবে। তাই চাই রেজিস্টার। নাৎসিবাহিনী বাড়িবাড়ি ঘুরে এই খাতা তৈরি করল। এল বিশেষ এক ব্যাজ। নিয়ম করা হলো, হলুদ তারা আঁকা এই ব্যাচ সব ইহুদির জামায় লাগাতেই হবে।  ইহুদিদের আলাদা আইডেন্টিটি কার্ডও দেওয়া হলো। ব্যবস্থাখানা এমন, কিছুতেই পরিচয় লুকনো যাবে না। আবার পরিচয় জানা মাত্রই শুরু হয়ে যাবে কোনঠাসা করা। 

এই একই ব্যবস্থা চালু আছে প্যালেস্টাইনেও। ফিলিস্তিনিরা নিজভূমে পরবাসী। আশ্চর্যের বিষয় এবার উল্টোদিকে ইহুদিরা, যারা একদিন পথকুকুরের চেয়েও অনেক খারাপ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিল। প্যালেস্টাইনে ইহুদি শাসক বেছে বেছে চিহ্নিত করে কে ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনিদের আলাদা পরিচয়পত্র, গাড়ির আলাদা নম্বরপ্লেট, আলাদা রাস্তা। পালাবার কোনো পথ নেই।

প্রশ্ন হলো, ভারতরাষ্ট্রও কি ঠিক এমন ব্যবস্থাই করতে চাইছে মুসলিমসমাজের জন্য? একদিকে সরকারি নিদান, অন্য দিকে নেতাদের সমাজমাধ্যমে বয়ান কি আসলে জনমনপ্রস্তুত করা, আর অপরকে শণাক্ত করাই নয়? কাঁওয়ারের দোকানদারদের যখন বলা হলো নাম প্রকাশ করো, এ কথার নিহিতার্থ কি তবে এই যে শাসকও মুসলিমকে অবিশ্বাস করে? অবিশ্বাস্যে ইন্ধন দেয়? মুসলিম মানে নাম কাটা, নাম প্রকাশ করে তাই প্রমাণ করতে হবে, আর যাই হই আমি মুসলিম নই?

অনেকেই বলেন, অন্তত সাতটা দশক ভারত রাষ্ট্র নিয়ে এমন প্রশ্নের অবকাশ ছিল না। সংবিধান আমাদের বেঁধে রেখেছিল। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার—এই বোধ মনের গভীরে প্রোথিত ছিল। কিন্তু বিষবৃক্ষ একদিনে মাটি ফুঁড়ে বের হয় না। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকসঙ্ঘ ‘প্যারামিলিটারি’-র সক্রিয় সদস্য চল্লিশ লক্ষ। এই চল্লিশ  লক্ষ মানুষ শুধু নিজেরাই অস্ত্র হাতে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বিশ্বাস করে না, চারপাশেও এই মতাদর্শ যেনতেনপ্রকারেণ ছড়িয়ে দেয়। হিটলারের যে দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্বের শ্লাঘা তা ভারতবর্ষে জায়গা করে নিয়েছে চুপিসারে। রামরথযাত্রা শুরুর অনেক আগে, সেই ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে রামায়ণ সম্প্রচারের মধ্যে দিয়ে হিন্দুত্ববাদী মানসলোককে চক্রবৃদ্ধিহারে সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়।

বাবরি ধ্বংসের দিনগুলিতে হিন্দুত্বের ছাতা বড় করার কাজ করেছেন কে এন গোবিন্দাচার্যের মতো আরএসএস-এর তাত্ত্বিক প্রবক্তা। গোবিন্দাচার্য মনে করেন, সংবিধান পরিবর্তন জরুরি কারণ তা ইওরোপীয় ছাঁচের। তিনি মনে করেন, মুসলিম সমাজ উস্কানি দেয় অতএব হিন্দুদের চুপ করে থাকার কোনো কারণ নেই। আরএসএস-এর সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়রিং-এর ভিত্তি গোবিন্দাচার্যের তত্ত্বায়ন। এই তত্ত্বের প্রতিফলন দেখা যাবে অযোধ্যায়। রামন্দিরকে কেন্দ্রে রেখে চারপাশে গড়ে তোলা  নিষাদ রাজা, বাল্মিকী মন্দিরে। আরএসএস চেয়েছ, প্রত্যক্ষ একেশ্বরবাদী মুসলিমের বিরোধী হিন্দুত্বের ছাতা বড় করতে। দলিত আদিবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করতে, স্কুল শিক্ষায় হিন্দুত্বকে অন্তর্ভুক্ত করতে। নারীর জীবন কেমন হবে, তার রূপরেখা তৈরি করতে। ক্রমে গড়ে উঠেছে এক বিরাট হিন্দুত্ববাদী মানসলোক যা মানবতার চেয়ে অনেক বড়, হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সদা মরিয়া। 

যে ক্ল্পলোকের অংশীদার মুসলিমকে যবন মনে করে, ক্ষণে ক্ষণে নি:সংশয়  হতে চায়, সামনের লোকটি মুসলিম নয় তো?

ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ‘যাদের বেশি বাচ্চা’, ‘পোশাক দেখলে চেনা যায়’ জাতীয় লব্জ ব্যবহার করেন,  তা একটি সুপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ধরতে হবে। ধরে নিতে হবে মুসলিম নই এটা প্রমাণ করাই স্বাভাবিকতা।

নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা এই, এই দুর্দিনের আভাস তিনি একশো বছর আগে পেয়েছিলেন।

Arka Deb

About Author

You may also like

দাশু আমাদের দাদা
Non-Fiction Writing

দাশু আমাদের দাদা

আমরা যারা নাম না জানা গঞ্জ মফসসলের ভূত, স্ট্যাম্পমারা বাংলা মিডিয়াম, মাস্টারদের ভাষায়- ছোট থেকেই দাগী, তাদের বড় হওয়ার কোনো
মারাদোনা থেকে মেসি
Non-Fiction Writing

মারাদোনা থেকে মেসি

চোখ যতই উজ্জ্বল হোক, যতই থাকুক মুসকো গোঁফ, ঠেলায় না পড়লে বেড়াল কখনও বাঘ হয় না। হঠাৎ একদিন কেউ সমুদ্রের 

Arka Deb is presently the Editor-in-Chief at Inscript.me. In the past, Arka has worked as Senior Journalist at CNN Network 18, Asianet News and Anandabazar Patrika.