আমরা যারা নাম না জানা গঞ্জ মফসসলের ভূত, স্ট্যাম্পমারা বাংলা মিডিয়াম, মাস্টারদের ভাষায়- ছোট থেকেই দাগী, তাদের বড় হওয়ার কোনো তাড়া ছিল না। বাংলা স্কুলের এই ফ্যা-ফ্যা ছেলেদের জীবনে চ্যাপলিন বা বাস্টার কিটন হঠাৎ একদিন কমিক রিলিফ হয়ে আবির্ভূত হননি। আমাদের ছিল স্বপ্নের স্কুলবাড়ি, নরমগরম মাস্টার, জ্যামিতির চক্রবুহ্য, লড়াইক্ষ্যাপা বন্ধু আর পাগলা দাশু। শিক্ষককে নকল করা ছিল আমাদের মৌলিক অধিকার। তাদের টাকজরিপ আর নামকরণ ছিল আমাদের পবিত্র কর্তব্য। শিক্ষককে ভয় দেখানোর চেষ্টা করার মধ্যেই শৌর্য খুঁজেছিল আমাদের বন্ধুরা। এই বন্ধুরাই আবার সুযোগ পেলে একে অন্যের জীবন নরক গুলজার করে দিয়েছে। রোগা সৈকত মোটা উদয়কে দৌড় করিয়েছে গোটা স্কুল, অরুণাভর গোলচে মাথায় সেদ্ধ ডিম ফাটিয়েছে রাজর্ষি। এসব কাজে আমাদের ট্রেনিং ম্যানুয়াল ছিল পাগলা দাশুর কীর্তিকলাপ। এক অর্থে দাশু আমাদের দাদা, পথপ্রদর্শক। ক্লাসঘরে স্যারের প্রশ্রয়ে দাশুর জীবনীপাঠই আমাদের জেহাদি করে তুলেছিল। আমরা মনে মনে জানতাম, এমনই হতে হবে। জ্যামিতি আর ফিচলেমি দুইই শিখতে হবে, এই দুইয়েই গড়া মানুষের মন। সে মনের মুক্তি মানুষকে অতিষ্ঠ করে ফেলায়, শিখিয়েছে দাশু।
তবে আমরাই শেষ। ঐতিহ্যের বিস্তার এই পর্যন্তই। আমরা মানে নব্বই, যাদের জীবনকে নিজেরা তো বটেই বাবা মা-ও খুব একটা সিরিয়াসলি নেয়নি। কর্পোরেট কৈশোর কাটাতে আমরা বাধ্য হইনি, সুতোটা খানিক ছাড়াই ছিল। বন্ধুদের ভিড়ে নিজেকে মস্করার পাত্র বানাতে আমাদের দ্বিধা ছিল না। ছোট ছোট অপরাধের ঝোঁক ছিল, বন্ধুকে বিপদে ফেলার নেশা ছিল, গোপাল অতি হিংসুটে-সুবোধ বালক, অতএব তার কান মুলে দিতে হবে, এই ধারণাই ছিল বদ্ধমূল। আমাদের এই সামান্য জীবন বকলমা দেওয়া ছিল দাশরথির চরণে।
দাশু মুখ খারাপ করত। টিট ফর ট্যাট। ‘পাগলা দাশু’ গল্পে জগবন্ধুর কাছে সে ইংরেজি পড়া বুঝতে চেয়েছিল। জগবন্ধু তাকে খুব করে কথা শোনায়। দাশু এসব ভালো চোখে দেখেনি। প্রথমেই সে মুখ খারাপ করেছে। তার ভাষায় জগবন্ধু ছিল ‘চ্যাঁচড় ছোটলোক’। তারপর সুদে আসলে প্রতিশোধ। জগবন্ধুর গ্রামার বইয়ের জায়গায় সে রেখে দিয়েছে ‘যশোবন্ত দারোগা-লোমহর্ষক ডিটেকটিভ নাটক’। মাস্টারমশাইয়ের সামনে জগবন্ধুর ইজ্জতে সে কী গ্যামাক্সিন! ‘চীনে পটকা’ গল্পে রামপদ দাশুকে মিহিদানা দেওয়ার আগে শর্ত আরোপ করেছিল, মিহিদানা খেলে রামপদর পিছনে আর লাগা যাবে না। দাশু মিহিদানা নিল এবং কুকুরকে খাইয়ে দিল। তারপর ক্লাইম্যাক্স। সেই মিহিদানার হাঁড়িতেই সে চিনেপটকা রেখে ফাটাল পন্ডিতমশাইয়ের চেয়ারের নীচে। গোটা ক্লাস হুলুস্থুল। অপমান সহ্য করা যাবে না। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, ইস্কুল-সভ্যতায় এটাই রীতি, এই রীতির প্রবর্তক দাশু। ‘দাশুর কীর্তি’ গল্পে দাশু বাবুয়ানি আর দেমাকসর্বস্ব নবীনচাঁদকে সবক শেখায়। জ্যোতিলালের বাড়ি যাওয়ার সময় কারা যেন নবীনচাঁদের মাথায় ধুনুচি ভাঙে, পিরানে (এক ধরনের ঢিলে জামা) পিচকিরি মেরে চলে যায়। ক্রমে জানা যায়, এ কাজ এক ক্লাস উঁচুতে পড়া কেষ্টর করা, দাশুরই তত্ত্বাবধানে। দাশু সেই সময় কাছেপিঠেই ছিল, নবীনচাঁদকে ভয় দেখাতে বলেছিল, ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক — নইলে দরাম্ করে তোর মাথা উড়িয়ে দেব।’ ডাকাতের ভয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা নবীনের বড়মামাকেও দাশুই অকু্স্থলে নিয়ে আসে। এখানেই শেষ নয়, নবীন তার দাদা মোহনকে বিহিতের জন্যে ক্লাসে আনে। মোহন বাকবিতণ্ডার মধ্যে দাশুর কান মুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ঠিক কত জোরে নবীনকে মেরেছিল কেষ্ট। দাশু আর সময় নষ্ট করেনি। এন্ট্রান্স ক্লাসের মোহনকে সে মুহুর্মুহু কিল, ঘুষি, চড়ে পর্যুদস্ত করে। শেষে বলে, ‘এর চাইতেও আস্তে মেরেছিল’। এসব থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছিলাম, এসপারওসপার যা হওয়ার রণাঙ্গনেই হবে। শত্রুসংহারে নেমে স্কুলব্যাগ ছিঁড়ে, গায়ে কাদা মেখে, শার্টের বোতাম ছিড়ে বাড়ি ফিরেছি মফসসলের সেই ভূতেরা, দাশু যাদের দাদা।
সুকুমার রায় দাশুর চরিত্রকে ঔপনিবেশিক স্কুলশিক্ষার প্রতিবশেই তৈরি করেছিলেন। এই শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি শেখাটা মাস্ট, অঙ্ক কষতেই হবে। আমরা দেখতে পাই, দাশু প্যান্টালুন পরে স্কুলে হাজির হয় কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ভালো করে ইরেজি শিখব বলে। অবসরে সে গসাগু কষে। মোহনচাঁদ যখন তাকে তাচ্ছিল্যের স্বরে জিজ্ঞেস করে,’ কী হে ছোকরা তুমি সব জানো নাকি?’, দাশু বলে, ‘না সব আর জানব কোত্থেকে, এই তো ক্লাস ফোরে পড়ি, একটু ইংরেজি জানি, ভূগোল, বাংলা. জিওমেট্রি।’ আসলে সুকুমার রায় দাশুকে সামনে রেখে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ভবিষ্যতের দাশুদের কী কী জানতে হবে। কিন্তু গোপাল-রাখাল বাইনারিতে একদিকে সর্বজ্ঞ সুবোধ হয়ে ওঠা. অন্য দিকে বখাটে বেপরোয়া হয়ে ওঠা, দাঁড়িপাল্লার এমন বিদ্যাসাগরীয় দুই দিক সুকুমার তৈরি করেননি। মধ্যে একটা সোনালি আলপথ ছিল। ঔপনিবেশিক কেরানি হওয়ার শিক্ষাঙ্গনের সব দরজা জানলা খুলে দিতে চেয়েছিলেন সুকুমার রায়, যাতে আগামী দিনগুলিতে দাশু-পড়ুয়াদের প্রবৃত্তির স্বাভাবিক বিকাশ হয়, খোলামেলা মন গড়ে ওঠে। জ্যামিতির বিন্দু মেলানোর পাশাপাশি শিশু বন্ধুদের মধ্যে যেন ফিচলেমি, মিচকেমির তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে বড় হয়। তেমনটাই হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, দাশু যতই দৌরত্ম্য করুক, পন্ডিতরা দাশুকে খুব একটা শাস্তি দেন না। সে পাগল বলে সাজামুকুব হয়। এই পাগলামিটুকু যে সংরক্ষণযোগ্য তাই বুঝিয়ে দিতে চান সুকুমার রায়। আরও একটা জিনিস দেখার, এসব ঘটনার জের বাড়ি অবধি গড়ায় না, বাবা মায়েরা ছুটে আসেন না ছেলের হয়ে গলা ফাটাতে, বড় জোর আসে স্কুলেরই বড় দাদা। অর্থাৎ অভিভাবনের বাড়তি চাপ মুক্ত একটা জীবনযাপনের ইশারা দিতে দিতে যান সুকুমার। আমাদের অভিভাবকরা যারা বইমেলা থেকে আমাদের পাগলামির এই মহাঔষধ কিনে দিয়েছেন, তারাও নীরবে আমাদের এই ভাবে বেড়ে ওঠার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। আর আমরা দাশুর পাগলামিকে যথাযথ সমীহ করেছি, মূল্য দিয়েছি। দাশু আমাদের দাদা। আমাদের সবচেয়ে পরিচিত চরিত্র, সুকুমার সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাঞ্জল, ব্যপ্তিতে সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্ব। জীবনসায়াহ্নেও হাসায়, কাঁদায় দাশু। স্কুলে তো বটেই, আমাদের প্রতিটি পাড়ায় এক বা একাধিক দাশু ছিল। খ্যাপাটেকে লোকে আদর দিত।
কিন্তু দোজ ডেজ আর গন। সোভিয়েতের পতন আর খোলা অর্থনীতির তোপধ্বনি আমাদের যাবতীয় হিসেবনিকেশ বদলে দিচ্ছিল। মিলিনিয়াম আসতেই সেই জীবন হয়ে উঠল এক অদ্ভুত দশ পঁচিশের ছক। কর্পোরেট ধাঁচায় বাঁচতে গেলে চাই কর্পোরেট শিক্ষা। এই শিক্ষায় পার্কের কোনো ভূমিকা নেই। স্কুলে জামা ছেঁড়া নট অ্যালাউড। অভিভাবকের নজরদারি হার মানাবে দাসব্যবস্থাকেও। কোনো অবকাশ নেই অথবা অবসরটুকু বিনিয়োগ করা হয়েছে ভবিষ্যতের লাভের আশায়। রয়েছে বড়দের মতো টার্গেট। অ্যাচিভ করতেই হবে। না হলে জুটবে মার, অপমান, গ্লানি। আসলে তো অঙ্ক ইংরেজি শেখার স্কুল নয়, গোটাটাই বাবা মায়ের প্রত্যাশার পাহাড় বয়ে চলার সিসিফাস আখ্যান। এই আখ্যানে ভুলের ক্ষমা নেই। ‘দাশুর খ্যাপামি’ গল্পে নাটকের ডায়লগ দাশু ভুল বলেছিল, তার কোনো পারফরমেন্স প্রেশার ছিল না। আমরা যারা দাশুর অনুগামী, আমাদের কারো এই চাপ ছিল না। পাড়ার অনুষ্ঠানে, স্কুলের নাটকে, বন্ধুদের মধ্যে একটু ভুলের জন্য জায়গা রাখা ছিল সস্নেহে। সেই ভুলটাই ছিল মধুরতুমুল স্মৃতির আখর। আজ স্বার্থপর দৈত্যের বাগানে ভুলের জায়গা নেই। বন্ধুহীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো যে জেগে আছে, অভিভাবকের ধমকধামকে ক্লান্ত ধস্ত সেই মানুষটির পৃথিবীতে দাশু কোথায়! সে কোথাও নেই বলেই যে শিশু বড় হচ্ছে আজ তার মন অন্যরকম। সে লকাররুম চিনতে শেখে, শিখে নেয় ব্লু হোয়েল। কী একা, কী একা সে! হিংস্র, স্বার্থপর, ত্রস্ত, খ্যাপামিবর্জিত এই জীবন টানতে টানতে যন্ত্রটা একদিন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দাশু যদি একবার তার কথা জানত, বাবা-মা, শিক্ষক—সকলকে ভেলকি দেখিয়ে তাকে বুকে টেনে নিত ঠিক।