সিনেমার ধর্ম ভাবানো। কল্পনার বিস্তারে ইন্ধন জোগানো। বোধের ঘরে তুমুল উতরোল, মনের বন্ধন মুক্তি। যিনি সিনেমা বানাচ্ছেন, তিনি জানেন না শেষমেশ দর্শকের ইন্দ্রিয়ে কী সমাচার যাবে, কেমন প্রতিক্রিয়া হবে। জানেন না বলেই তিনি বারবার পরীক্ষা দেন। আর অসিনেমা? সে প্রথমেই ভাবনার শ্বাসরোধ করবে, আষ্টেপৃষ্টে বাঁধবে মনকে, দৃশ্যমালার সাহায্যে আগেভাগে চিহ্নিত করা গোষ্ঠীকে একটা বার্তা গিলতে বাধ্য করবে। জার্মান পরিচালক লেনি রিফেস্তাল ১৯৩৪ সালে বানিয়েছিলেন ‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল’। ছবিতে দেখা হয় গোটা বিশ্বের ষড়যন্ত্রের মধ্যেও কী ভাবে মহামতি হিটলারের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াল জার্মানি। কেন হয়েছিল এই অসিনেমা? কারণ হিটলার চেয়েছিলেন, হোক। জার্মানির শত্রু কারা আর একটা মাছিগোঁফওয়ালা লোকের বাহুবল ঠিক কতখানি তা মানুষ জানুক। গত এক দশকে এমন অসিনেমা বারবার ভারতের সংস্কৃতির বাজারেও ঘাঁই মেরেছে। শাসকের কাঙ্খিত বার্তা জনতাকে গেলানোর উদ্দেশ্যে মাঠে নেমে সফলও হয়েছেন অনেকে। এই লিস্টের শীর্ষে, চেরি অন দ্য কেক হয়ে রয়েছে বিবেক অগ্নিহোত্রীর কাশ্মীর ফাইলস। সম্প্রতি এ ছবিকে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হলো। কোন ছবি, কী দেখেছিলাম ছবির দৃশ্যে-দৃশ্যান্তরে, কখন পুরস্কৃত করা হচ্ছে এই নির্মাণকে– এই প্রশ্নগুলির মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলেই পুরস্কারের অস্যার্থ পরিষ্কার হবে।
কাশ্মীর ফাইলস প্রায় আড়াই ঘণ্টার দৃশ্যকোলাজ। এই সময়কে ব্যবহার করে এই দৃশ্যমালা কাশ্মীরি হিন্দুদের সাথে ঘটা অন্যায়কে উপজীব্য করে কয়েকটি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। বেঝানো হয়, অতীতে কোনো রাজনৈতিক দল কাশ্মীরী হিন্দুদের কথা ভাবেনি। তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা না রেখেই সবচেয়ে মর্মান্তিক ভাবে পণ্ডিত হত্যা-বিতারণকে তুলে ধরা হয়। নিত্যসত্য হিসেবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়- জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চিন্তাচর্চা চলে তা একপেশে, কাশ্মীরী হিন্দুদের স্বার্থের বিরোধী, ওখানেই টুকরে টুকরে গ্যাং-এর বেসাতি। হিন্দু খতরে মে হ্যায়- প্রত্যেকে যাতে এই বোধ নিয়ে বাড়ি ফেরে, তা নিশ্চিত করতে যথেচ্ছ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন বিবেক অগ্নিহোত্রী।
বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, কেন বিজেপি এই সিনেমার স্বপক্ষে গলা ফাটিয়েছে নানা রাজ্য, কেন করমুক্ত কর হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘এমন ছবি আরও চাই’। বলেছিলেন, ‘বাকস্বাধীনতার ধ্বজাধারীরা কেঁপে গিয়েছে।’ তাঁর মত ছিল, এমন ‘সত্য’ বাইরে আনা উচিত।
মোদীব্রিগেডের কাছে যা সত্য, ইতিহাসের ছাত্র বেশিরভাগ সময়েই বিষয়ের বাধ্যবাধ্যকতায় তাকে পোস্টট্রুথ বলতে পারে। তবে কাশ্মীর ফাইলস অনুরাগীদের সামনে এসব বললে একঘরে হতে হবে। কেননা এই সিনেমা প্রথমেই প্রতিষ্ঠা করেছ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আসলে সত্যকে রেখেঢেকে ছাত্রদের আর্বান নকশাল বানায়। তাই মোদীর কথাই মানতে হবে। আর মোদীর কথা মানলে সত্য হলো বিশ্বাস। ক্ষমতা কায়েম রাখতে গেলে যা চাপিয়ে দিতে হয়। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, মন কি বাতের মাধ্যমে, শেষতক সিনেমার মতো বহুমাত্রিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে। যা আমি বলতে চাই, যাকে আমি অপর করতে উদ্যত – আমার হয়ে একটি মহৎ, শেষ বিশ্বাসযোগ্য শিল্পমাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি সেই কাজ করে, তবে তাকে তো আমি সেরার শিরোপা দেবই। মাথায় করে রাখব।
কাজেই বিনাপ্রশ্নেই মেনে নেওয়া উচিত কাশ্মীর ফাইলস জাতীয় পুরস্কারের যোগ্য। সামনে লোকসভা ভোট, এখন অস্ত্র মজুত করার সময়। যে অস্ত্রের মুখে লেগে আছে ঘৃণার বিষ। এই ছবিটিকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা সহজ, ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দেওয়া সহজ। ইউটিউবে ফ্রি ভার্সান রেখে দিলে কোটি কোটি লোক এই চুম্বকে এক হবে। হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়বে বিনা পরিশ্রমে। পাশাপাশি বোঝানো যাবে মোদী জমানায় অখণ্ডতার অর্থ কী, এই অখণ্ড বোধে অপর কে। না বুঝতে পারল প্রধানমন্ত্রী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন দেবেন, বলবেন ইহাই পরম সত্য। ক্রমে কাশ্মীর তথা গোটা ভারতকে জানান দেওয়া যাবে, হিন্দুজাগরণ সম্ভব ভরসা রাখলে। কাশ্মীরী হিন্দুদের পুনর্বাসন তথা ন্যায়প্রতিষ্ঠা সম্ভব বিজেপি থাকলেই। যে যে খানে আছে হিন্দু, বিপদগ্রস্থ হিন্দু, আচ্ছে দিনের স্বপ্নদেখা হিন্দু, অস্তিত্বসংকটে মনে-মেঘ হিন্দু এক দেশ, এক রেশন, এক ভোট, এক সরকার, এক নেতার পক্ষে ভোট দেবে আরও একবার। একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
এসবের মাঝে খবর আসবে উত্তরপ্রদেশে মুসলিম ছাত্রকে শিক্ষকের নির্দেশে চড় মারছে হিন্দু সহপাঠীরা। খবর আসবে, বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মুসলিমের বাড়ি। খবর আসবে দলিতের মুখে পেচ্ছাপ করে দিল বিজেপি নেতা। সত্য বলে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষক।
যা দেখি, যা শুনি- সত্য, তবু সত্য নয়।
কারণ, রাজা যাকে সত্য মানেন, সত্য আসলে তাই-ই। আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে।